জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব প্রতিনিধি ॥
দেশ কখনও দুইবার স্বাধীন হয় না—ইতিহাসকে বিকৃত করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বিজয়ের মাসে ভৈরবে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, এর বাইরে স্বাধীনতার নতুন কোনো সংজ্ঞা ইতিহাসসম্মত নয়।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ, ভৈরব উপজেলা শাখার উদ্যোগে সোমবার (ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টায় ভৈরবের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টের হলরুমে এই সংবর্ধনা ও উপহার বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ভৈরব উপজেলার ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ সম্মাননা ও উপহার প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ ভৈরব উপজেলা শাখার সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, দৈনিক যুগান্তরের ভৈরব প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান ফারুক। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভৈরব উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. তোফাজ্জল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল বাহার, সদস্য সচিব মো. ফজলুর রহমান, পৌর বিএনপির সভাপতি হাজী মো. শাহীন, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভিপি মুজিবুর রহমান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সারোয়ার আলম মাসুদ, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম আঙ্গুর, সহ-সভাপতি ফাতেমা বেগমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দেলোয়ার হোসেন সুজন অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব পালন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মো. সজীব আহমেদ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। এরপর শহীদ ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে ফুল দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হয়।
সংবর্ধনা পর্বে উপস্থিত ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ‘বিজয়-২৫’ লেখা বিশেষ মাফলার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংক্ষিপ্ত তথ্যসম্বলিত স্মারক এবং একটি করে গ্লাস মগ উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন ভৈরব পৌরসভার তিনবারের সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা ফখরুল আলম আক্কাছ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফিরোজুর রহমান মোল্লা, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. তোফাজ্জল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল বাহার, ফরিদ আহমেদ এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মো. মোস্তাক আহমেদসহ অন্যান্যরা।
বক্তারা বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনো বিকল্প ইতিহাস নেই। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং তার ফলেই আজ দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করছে, শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠেছে এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বক্তারা অভিযোগ করেন, ৫ আগস্টের পর একটি কুচক্রী মহল পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটেছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই মহলটি দাবি করছে যে ৫ আগস্টের ঘটনা নাকি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। বক্তারা এই দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ইতিহাসবিরোধী আখ্যা দিয়ে বলেন, কোনো গণঅভ্যুত্থান কখনো স্বাধীনতার বিকল্প হতে পারে না। দেশ একবারই স্বাধীন হয়, বারবার নয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরও বলেন, “আমরা হয়তো অস্ত্র জমা দিয়েছি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রশিক্ষণ জমা দিইনি। ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা আমরা প্রতিহত করব।”
সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান ফারুক বলেন, বয়সের ভারে মুক্তিযোদ্ধারা আজ অনেকটাই ক্লান্ত, কিন্তু তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, সেই কুচক্রী মহলকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি সারোয়ার আলম মাসুদ বলেন, ভবিষ্যতে যখন বীর মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে থাকবেন না, তখন তাঁদের সন্তানরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিএনপি সবসময় মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে এবং ১৯৭১ সালের চেতনাকে বিশ্বাস করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় তাঁর দল অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে।
অনুষ্ঠানটি শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনার মধ্য দিয়ে।
Post a Comment