ভৈরবে চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ, শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে জেলেদের ক্ষোভ

জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব প্রতিনিধি ॥

“মা ইলিশ ধরবো না, দেশের ক্ষতি করবো না” — এই স্লোগানকে সামনে রেখে ইলিশ প্রজনন মৌসুমে নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের মাঝে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল বিতরণ শুরু হয়েছে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। কিন্তু এ কর্মসূচিকে ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা।

মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) দুপুরে পৌরসভা প্রাঙ্গণে সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের আয়োজনে চাল বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়। বিতরণ কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন ভৈরব পৌরসভার ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার সিদ্দিকুর রহমান।

অনিয়মের অভিযোগ তুললেন জেলেরা

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান চলাকালে ইলিশ আহরণে ২২ দিন বিরত থাকা জেলে পরিবারগুলোকে সহায়তা হিসেবে ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভৈরবে এই কর্মসূচির তালিকা তৈরিতে হয়েছে নানা অনিয়ম—এমন অভিযোগ তুলেছেন জেলেরা।

তাদের অভিযোগ, প্রকৃত পেশাদার ও হতদরিদ্র জেলেদের অনেকেই বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে, অথচ বেশ কয়েকজন সচ্ছল ব্যক্তি ও বিদেশপ্রবাসীর পরিবারের সদস্যরা চালের কার্ড পেয়েছেন। অনেকেই আবার জেলে নন, ভিন্ন পেশায় জড়িত থেকেও এই সহায়তার তালিকায় নাম তুলেছেন।

একজন ক্ষুব্ধ জেলে ফারুক মিয়া বলেন,

> “আমরা এখন নদীতে মাছ ধরতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই। অথচ প্রকৃত জেলেদের নাম বাদ দিয়ে অন্যদের চাল দিচ্ছে। আমি বহু বছর ধরে মাছ ধরছি, কিন্তু এবার নামই রাখেনি।”



আরেক জেলে হক মিয়া বলেন,

> “আমার জেলে কার্ড আছে। তারপরও তালিকায় নাম নাই। অন্যদিকে যাদের ছেলে বিদেশে থাকে, তারাও চাল পাইতাছে। এটা অন্যায়।”



জেলে বাদল মিয়া বলেন,

> “অনেকের ছেলে বিদেশে, তাদের নাম তালিকায়। আমরা যারা নদীতে দিনরাত মাছ ধরি, আমাদেরই বাদ দিছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।”



বিতর্কের পর অতিরিক্ত পাঁচ জেলে পেলেন চাল

চাল বিতরণের সময় উপস্থিত জেলেরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শে অতিরিক্ত পাঁচজন জেলেকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের প্রত্যেককে ২৫ কেজি করে চাল দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউন্সিলর ও শিক্ষা অফিসার সিদ্দিকুর রহমান।

তিনি বলেন,

> “১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৬ জন জেলের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৩০ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। বিতরণের সময় আরও পাঁচজন প্রকৃত জেলে শনাক্ত হওয়ায় তাদেরও চাল দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকেই কার্ড নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু দেখে প্রকৃত দরিদ্র মনে হয়নি। তাই সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি।”



প্রশাসনের ব্যাখ্যা

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয় বণিক বলেন,

> “মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ইলিশ ধরা, বিক্রি ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরকার এই সময় জেলেদের জন্য বিশেষ সহায়তা হিসেবে ভিজিএফ চাল বরাদ্দ দিয়েছে। ভৈরব পৌরসভা এলাকায় ২২০ জন নিবন্ধিত জেলেকে জনপ্রতি ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।”



তিনি আরও বলেন, জেলেরা চাইলে নদীতে ইলিশ ছাড়া অন্যান্য মাছ ধরতে পারবেন, তবে ইলিশ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

এ বিষয়ে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শবনম শারমিন জানান,

> “বর্তমানে ভৈরব পৌরসভা এলাকায় প্রায় এক হাজার জেলে পরিবার রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে ধাপে ধাপে সবাইকে চাল বিতরণের আওতায় আনা হবে। এই মৌসুমে মা ইলিশ ছাড়া অন্যান্য মাছ ধরতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”



স্বচ্ছতা নিশ্চিতের দাবি

স্থানীয় জেলেরা মনে করছেন, সরকারি ত্রাণ বা সহায়তা কর্মসূচিতে নিয়মিত অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত উপকারভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা দ্রুত তালিকা পুনর্গঠন এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রকৃত জেলেদের সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post