ভৈরবে ফাঁসিতে ঝুলে যুবকের আত্মহত্যা: মানসিক অসুস্থতা ও মাদকাসক্তিই কারণ বলে ধারণা

জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব প্রতিনিধি ॥

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন রাসেল মিয়া (২৫) নামের এক যুবক। সোমবার (৬ অক্টোবর) সকালে পৌর শহরের আমলাপাড়া অবদার মোড় এলাকার নিজ বাসা থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত রাসেল মিয়া স্থানীয় ভোলা মিয়ার ছেলে।

ঘটনার খবর পেয়ে ভৈরব থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার ফুয়াদ রুহানি।

মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন রাসেল

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাসেল পেশায় একজন অটোরিকশা চালক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছিলেন। প্রায় এক বছর আগে তার আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে পড়লে স্ত্রী এক মাস বয়সী কন্যাসন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি কুমিল্লায় চলে যান। সেই থেকে রাসেল আরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরিবার ও প্রতিবেশীদের মতে, এই মানসিক অস্থিরতা থেকেই ধীরে ধীরে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, রবিবার (৫ অক্টোবর) রাতে তিনি না খেয়েই নিজ ঘরে ঘুমাতে যান। সকালে ছোট ভাই ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরের সিলিং ফ্যানে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন রাসেল। পরে বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানো হয়।

‘সঠিক চিকিৎসা পেলে হয়তো এমনটা হতো না’

নিহতের বড় ভাই শাহদাত হোসেন বলেন, “রাসেল আমাদের চার ভাইয়ের তৃতীয়। সে মূলত শান্ত-ভালো ছেলে ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল। বাবা-মা কয়েকবার তাকে জেলে রেখেছেন যাতে চিকিৎসা হয়। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা ও মানসিক সহায়তার অভাবে ছেলেটি দিন দিন অবনতি ঘটাচ্ছিল। বউও তাকে ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।”

তিনি আরও বলেন, “রাসেল বিয়ের আগে একেবারে স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ করেই সে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আমরা যদি সময়মতো ভালো চিকিৎসা দিতে পারতাম, হয়তো আজ সে বেঁচে থাকত।”

পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে বিস্তারিত

ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার ফুয়াদ রুহানি বলেন, “আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করেছি। প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। তবে হত্যা না আত্মহত্যা—ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে বিষয়টি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা আমলে নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

স্থানীয়দের মন্তব্য

স্থানীয়রা জানান, রাসেল মিয়া দীর্ঘদিন ধরেই একা থাকতেন। মাঝে মাঝে তাকে রাস্তায় বা বাজারে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যেত। কেউ কেউ তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলেও অভিহিত করতেন। এলাকাবাসীর অনেকে বলেন, মানসিক রোগীদের জন্য পরিবার ও সমাজের সহানুভূতি না থাকায় অনেকেই এমন চরম সিদ্ধান্ত নেয়।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক রোগ ও মাদকাসক্তি বাংলাদেশের সমাজে ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষরা চিকিৎসার অভাবে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়ে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবার, সমাজ ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মানসিক সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ যেমন—বিষণ্ণতা, আত্মগোপন, অতিরিক্ত রাগ বা হঠাৎ আচরণ পরিবর্তন—এগুলো দেখলেই পরিবারকে দ্রুত মনোবিদ বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। এতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।

সামাজিক সচেতনতা জরুরি

ভৈরবসহ সারাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগের অভাব, মানসিক চাপ, বেকারত্ব এবং পারিবারিক কলহ এর মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মন্দির, এমনকি গণমাধ্যমেও নিয়মিত প্রচারণা চালানোর আহ্বান জানান তারা।

Post a Comment

Previous Post Next Post