পাগলা মসজিদের দানবাক্সে গ্রাম পুলিশের করুণ আকুতি
কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রায় পাঁচ মাস পর খোলা হলো কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স। এবার ১৩টি দানবাক্স থেকে উঠল ৩২ বস্তা টাকা, সঙ্গে স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রাও। তবে স্বাভাবিক নিয়মে অর্থ-সম্পদের পাশাপাশি আলোচনায় এসেছে কিছু চিঠি, যেখানে ভক্তরা তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর হৃদয়ের গোপন কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যেই নজর কেড়েছে এক গ্রাম পুলিশের লেখা হৃদয়বিদারক চিঠি।
শনিবার (৩০ আগস্ট) সকাল ৭টা থেকে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে দানবাক্স খোলা হয়। পুরো কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং ব্যাংক কর্মকর্তারা। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলা হলেও এবার তা হয়েছে ৪ মাস ১৮ দিন পর।
গ্রাম পুলিশের অশ্রুভেজা চিঠি
দানবাক্স থেকে পাওয়া চিঠিতে একজন গ্রাম পুলিশ লিখেছেন,
“হে আল্লাহ, আমি একজন সাধারণ গ্রাম পুলিশ। আমার মাসিক বেতন খুব সামান্য। তবে অর্থ বা সম্পদ আমার দরকার নেই। আমার একটাই মিনতি—আপনি আমার ছেলের প্রতি দয়া করুন। আপনি তাকে প্রতিবন্ধী বানিয়েছেন। কোনো গুণাগুণ তার মধ্যে দেননি। আমরা এই কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। মালিক, আপনার রহম চাই। আমিন।”
এই আকুতিপূর্ণ চিঠি পড়ে উপস্থিত অনেকের চোখ ভিজে ওঠে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তারা আল্লাহর কাছে ভরসা খুঁজে নেন—এই চিঠি যেন তারই প্রতিফলন।
প্রেম আর দ্বিধার কথা
দানবাক্স থেকে পাওয়া আরেকটি চিঠিতে লেখা,
“ভুল পথে আছি কিনা জানি না। তবে তুমি অন্তর্যামী। আমি শুধু চাই, যাকে পাঁচ বছর ধরে একইভাবে ভালোবাসছি, তাকে যদি আমার কপালে লিখে থাকো তবে কোনো অসম্মান ছাড়াই আমার করে দিও। আর যদি ভাগ্যে না থাকে তবে আমাকে ভুলে যাওয়ার শক্তি দাও। আমিন।”
প্রেম, বেদনা আর জীবনের অনিশ্চয়তা—সবই জায়গা করে নেয় এই চিঠিগুলোতে। কোনোটি চাকরির আশায়, কোনোটি পরীক্ষায় সাফল্যের প্রার্থনায়, আবার কোনোটি রোগমুক্তির আকুতিতে লেখা হয়।
কঠোর নিরাপত্তায় গণনা কার্যক্রম
দানবাক্স খোলার পর গণনা শুরু হয় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে। এ কাজে অংশ নেন—
৩৪০ জন মাদ্রাসাশিক্ষার্থী
১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
৩৩ জন শিক্ষক ও কর্মচারী
৯ জন সেনা সদস্য
৩০ জন পুলিশ সদস্য
৫ জন আনসার ব্যাটালিয়ন
১০ জন আনসার সদস্য
১০০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারী
তাঁদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে একে একে অর্থ, স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রা গণনা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারও টাকার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণালংকার ও বিদেশি মুদ্রা জমা পড়েছে।
দানবাক্সের সামাজিক তাৎপর্য
পাগলা মসজিদের দানবাক্স শুধু অর্থ সংগ্রহের জায়গা নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক নথি। এখানে পাওয়া চিঠিগুলো সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, ব্যথা, কষ্ট আর আশার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। কারও আর্থিক দুর্দশা, কারও পারিবারিক টানাপোড়েন, আবার কারও হৃদয়ের গোপন আকুতি—সবই ভেসে ওঠে এই চিঠিগুলোতে।
প্রশাসনের ভূমিকা
জেলা প্রশাসক জানান, প্রতিবারের মতো এবারও স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই দানবাক্স খোলা হয়েছে। টাকার সঠিক হিসাব শেষে মসজিদ পরিচালনা ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে তা ব্যয় করা হবে।
উপসংহার
ঐতিহাসিক এই মসজিদের দানবাক্স যেন কেবল অর্থ-সম্পদের ভাণ্ডার নয়, বরং মানুষের না-বলা কষ্ট, আশা-আকাঙ্ক্ষারও আখ্যান। বিশেষ করে গ্রাম পুলিশের সেই চিঠি আবারও প্রমাণ করে—অর্থ নয়, জীবনের প্রকৃত প্রার্থনা অনেক সময় স্বস্তি, মুক্তি আর সন্তানের জন্য মঙ্গল কামনায় সীমাবদ্ধ থাকে।
Post a Comment