নিজস্ব প্রতিবেদক
কিশোরগঞ্জ | ৭ আগস্ট ২০২৫
নিকলী হাওরের ছেলে নাজমুল হক হিমেল নতুন করে গর্বের এক অধ্যায় রচনা করেছেন বাংলাদেশের জন্য। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মাঝখানে অবস্থিত দুনিয়া বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে তিনি দেখিয়েছেন সাহসিকতা, আত্মবিশ্বাস ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির বাস্তব প্রমাণ।
জন্ম কিশোরগঞ্জের নিকলীর মীরহাটি গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই সুয়াইজনী নদীর জলে খেলতে খেলতেই গড়ে উঠেছে তাঁর সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসাকেই পরিণত করেছেন বৈশ্বিক সাফল্যে। তাঁর এই অর্জনে উচ্ছ্বসিত কেবল পরিবার নয়, সারা এলাকাবাসীও। তাঁরা মনে করছেন, নাজমুলের এই কীর্তি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
গত ২৯ জুলাই ইংল্যান্ড সময় সকাল সাড়ে আটটায় নাজমুল শুরু করেন তাঁর মহাসাহসিক অভিযান। তিনি পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ৩৩.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ইংলিশ চ্যানেল—যেখানে ঠান্ডা পানি, জেলিফিশ ও অনুকূল আবহাওয়ার অভাব বড় প্রতিবন্ধকতা। ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের অবিরাম সাঁতারে তিনি পৌঁছান গন্তব্যে। এই ঐতিহাসিক সাঁতার ছিলো শুধুই ক্রীড়ার সীমায় নয়; এটি ছিলো এক জাতীয় আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ।
নাজমুলের পিতা আবুল হাসেম আশির দশকে ছিলেন জাতীয় সাঁতারু এবং বর্তমানে কিশোরগঞ্জ নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ। ছেলের এমন অর্জনে আবেগে আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, “ছেলের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। ইংলিশ চ্যানেলের ১৫ থেকে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সাঁতার কাটা সহজ নয়। সে নিজের বাড়িতে বরফ ভর্তি ড্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে।”
শুধু পারিবারিক অনুশীলনেই থেমে থাকেননি নাজমুল। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন মো. সোলায়মানের কাছে, এরপর জাপানি ও চীনা কোচের অধীনে দক্ষতা বাড়ান। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে ২৬টি স্বর্ণপদক ও ২১টি রৌপ্যপদক অর্জন করেন। বয়সভিত্তিক সাঁতারেও ছয়টি জাতীয় রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে।
ইংলিশ চ্যানেল জয়ের মুহূর্ত প্রসঙ্গে নাজমুল বলেন, “এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। জেলিফিশের ভয়, ঠান্ডা পানি, সি সিকনেস—সবকিছু মোকাবেলা করে আমি বিজয়ের মুহূর্ত পেয়েছি। আমাদের টিমে মাহফিজুর রহমান ছিলেন শেষ ফিনিশিং ম্যান। যখন বোট থেকে হুইসেল দিল, তখন আমাদের উল্লাস সীমাহীন ছিল।”
ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা প্রথম বাঙালি ছিলেন ব্রজেন দাস, যিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ছয়বার এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে আবদুল মালেক ও ১৯৮৮ সালে মোশাররফ হোসেন এই পথ পাড়ি দেন। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর আবার বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল জয় করলেন নাজমুল হক ও মাহফিজুর রহমান।
গ্রামে ফিরে এসে নাজমুল হককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান নিকলীর ইউএনও রেহানা মজুমদার। তিনি বলেন, “নিকলীতে সুইমিংপুল নেই, কিন্তু এখানকার ছেলেরা উপজেলা পরিষদের পুকুরেই সাঁতার শিখছে। নাজমুল প্রমাণ করেছে, সীমিত সুযোগেও সাফল্য অর্জন সম্ভব।”
স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “নিকলী থেকে বহু সাঁতারু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলে গৌরব বয়ে এনেছে। কিন্তু আজও একটি আধুনিক সুইমিংপুলের অভাব রয়েছে। সরকার এ বিষয়ে নজর দিলে এখান থেকেই গড়ে উঠবে ভবিষ্যতের আরও ব্রজেন বা নাজমুল।”
নাজমুল বলেন, “আমার পরিবারে সবাই সাঁতারু। কিন্তু কেউ অলিম্পিকে যেতে পারেনি—এই আক্ষেপ থেকেই বড় কিছু করার সিদ্ধান্ত নিই। এই বিজয় শুধু আমার নয়, পুরো বাংলাদেশের জয়।”
আজ তিনি বিশ্বকে দেখিয়েছেন, হাওরের ছেলে থেকেও বিশ্বজয় সম্ভব। সাহস, অধ্যবসায় এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে সীমাবদ্ধতাও আর সীমাবদ্ধতা থাকে না।
Post a Comment