ছুটি ছাড়াই বছরের পর বছর শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, মাউশির শোকজ নোটিশ

কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে কয়েকজন শিক্ষক বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাননি বা ছুটির আবেদন করেননি। কারও অনুপস্থিতি ৬ বছর পেরিয়ে গেছে, আবার কেউ ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে নেই। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

অধিদপ্তরের কলেজ-১ শাখার সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ সফিউল বশরের স্বাক্ষরিত এক কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়, উল্লিখিত শিক্ষকরা বিনা অনুমতিতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থেকে সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা ও নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। নোটিশে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাদের ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—কেন বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।

সবচেয়ে দীর্ঘ অনুপস্থিতি রাজিব মিত্রের

তালিকায় রয়েছেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিব মিত্র, যিনি ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে ফেরেননি। অর্থাৎ তিনি টানা ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে কলেজে আসছেন না।

একই কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক তাহমিনা আখতার ২০১৯ সালের ১৪ জুন থেকে অনুপস্থিত। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক অপর্ণা রানী দাসও ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট থেকে কলেজে ফেরেননি।

পাবনা থেকে রাজশাহী—একই চিত্র

কেবল কিশোরগঞ্জ নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি কলেজেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক শামীমা ইয়াসমিন হীরা ২০২৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে অনুপস্থিত। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক রোকসানা পারভীন আক্তার সম্পা ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলে আসেননি।

মানিকগঞ্জের ঘিওর সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক রোকসানা আক্তার সম্পা ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নেই। চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক মো. সাজিদ হাসান ২০২৪ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে, আর টঙ্গী সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক উম্মে কুলসুম ২০২১ সালের ১৪ জুলাই থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন।

তালিকার শেষ নাম রাজশাহী কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক জেসমিন ফেরদাউস, যিনি ২০২২ সালের ৮ জুলাই থেকে কলেজে আসছেন না।

অধ্যক্ষদের দাবি—‘খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না’

মাউশির নোটিশে উল্লেখিত শিক্ষকদের মধ্যে তিনজনের মোবাইল ফোন নম্বর পাওয়া গেলেও সেগুলো বন্ধ ছিল। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর অধ্যক্ষরা জানান, ওই শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ নেই। তারা কোথায় আছেন, সেটিও জানা যাচ্ছে না।

প্রশাসনিক পদক্ষেপ আসন্ন

শিক্ষা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিতি সরকারি চাকরির বিধির গুরুতর অপরাধ। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে বরখাস্তসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। মাউশি ইতিমধ্যে বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষকে নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদী অনুপস্থিতি শুধু প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ নয়, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষতিও ঘটায়। বিশেষ করে সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট থাকায় একজন শিক্ষক অনুপস্থিত হলে সেই চাপ অন্যদের ওপর পড়ে এবং পাঠদান ব্যাহত হয়।

আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ জরুরি

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮’-তে স্পষ্টভাবে বলা আছে, বিনা অনুমতিতে ৩০ দিনের বেশি অনুপস্থিতি গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল। তবুও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিলম্বিত হয়, যা এ ধরনের অনিয়মকে উৎসাহিত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সমাজ ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা

শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি দায়িত্বশীল না হন, তবে এর সরাসরি প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়বে। তারা দ্রুত এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post