হাওরে অলওয়েদার সড়কে কালভার্ট ঘাটতি, মাছের চলাচলে বাধা

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে নির্মিত বহুল আলোচিত অলওয়েদার সড়ক এখন বিতর্কের মুখে। কারণ, সড়কটিতে যথেষ্ট কালভার্ট রাখা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে পানি ও মাছের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, যা হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
রোববার দুপুরে মিঠামইন অডিটরিয়ামে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার নিবন্ধিত মৎস্যজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এ বিষয়ে সরাসরি সতর্ক করেন। তিনি বলেন, “হাওরের ভেতর দিয়ে যাওয়া এই সড়ক তিনটি উপজেলা সংযুক্ত করেছে ঠিকই, তবে নিচ দিয়ে পানিপ্রবাহের সুযোগ অপ্রতুল। পর্যাপ্ত কালভার্ট না থাকায় মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, পাশাপাশি পানি আটকে থাকার ঝুঁকি বাড়ছে। এখনই নতুন করে কালভার্ট নির্মাণ না করলে দীর্ঘমেয়াদে হাওরের পরিবেশ ভাঙনের পথে যাবে।”

‘প্রকৃতির ক্ষতি মানুষের হাতেই’

সভায় ফরিদা আখতার আরও বলেন, “হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের মূল দায় মানুষের। সব প্রাকৃতিক পরিবর্তন প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, বরং অনেকটাই মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল। তাই হাওর রক্ষায় আমাদের সচেতন হতে হবে।”

তিনি স্পষ্ট করে দেন, প্রকৃত মৎস্যজীবী ছাড়া অন্য কাউকে হাওরের জলমহাল ইজারা দেওয়া যাবে না। কারণ, প্রকৃত জেলেরা টেকসই উপায়ে মাছ ধরতে জানেন, অথচ বাইরের অনেক দখলদার পরিবেশের ক্ষতি করছেন।

দেশি মাছ বিলুপ্তির পথে

হাওরের বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে ফরিদা আখতার বলেন, “নানা কারণে হাওরে পানির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এর ফলে দেশি প্রজাতির মাছ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। মাছ না থাকায় জেলার হাজারো জেলে জীবিকা হারাচ্ছেন। কেউ পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন, আবার কেউ শহরমুখী হচ্ছেন জীবিকার খোঁজে।”

স্থানীয় মৎস্যজীবীদের দাবি, একসময় হাওরের প্রতিটি মৌসুমে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। এখন সেই মাছের দেখা মেলে না বললেই চলে। ফলে অনেক পরিবার ঋণগ্রস্ত, কেউ কেউ পেশা বদলে রিকশা চালানো বা দিনমজুরির কাজ করছেন।

‘অলওয়েদার সড়ক সুফল দেবে, তবে প্রকৃতি বাঁচিয়েই’

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অলওয়েদার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। তিনটি উপজেলাকে সরাসরি সংযুক্ত করায় কৃষিপণ্য পরিবহন ও চলাচল সহজ হয়েছে। তবে এর দীর্ঘস্থায়ী সুফল পেতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। পর্যাপ্ত কালভার্ট নির্মাণ করলে পানি চলাচল স্বাভাবিক থাকবে, মাছও টিকবে, আবার সড়কের কার্যকারিতাও অক্ষুণ্ণ থাকবে।

সভায় উপস্থিতি

কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেজাবে রহমতের সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সভায় মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রউফ, সহকারী পুলিশ সুপার সুবীর কুমার সাহা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ মামুনসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় বক্তারা একযোগে বলেন, শুধু অবকাঠামো নয়, হাওরের জীবনধারা ও জীববৈচিত্র্যকেও বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। নইলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, অন্যদিকে হাওরনির্ভর মানুষের জীবিকা ধ্বংস হবে।

পরিবেশবিদদের সতর্কবার্তা

পরিবেশবিদদের মতে, হাওরের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার শর্ত না মেনে বড় অবকাঠামো নির্মাণ করলে হাওরের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে পারে। পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ ও মাছের আবাসস্থল নিশ্চিত করাই এখানে প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

Post a Comment

Previous Post Next Post