নিজস্ব প্রতিবেদক, কিশোরগঞ্জ
সরকারি বরাদ্দে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই। কিন্তু ঠিকাদারের অবহেলা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকিতে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ আজও ঝুলে আছে। ফলে বিদ্যুৎবিহীন, সঙ্কীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ টিনশেড কক্ষে গাদাগাদি করে চলছে শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম—শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই চরম দুর্ভোগে।
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অর্ধসমাপ্ত ভবন
কাশোরারচর, চৌধুরীহাটি ও বত্রিশ বঙ্গবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে তিনতলা বিশিষ্ট ভবন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) পিইডিপি-৪ (ফোর্থ প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) এর আওতায়। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বহু আগেই। পরে বর্ধিত সময়ও শেষ হয় ২০২৪ সালের জুনে, তবুও কাজ শেষ হয়নি।
সরেজমিনে করুণ চিত্র
কাশোরারচর বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে—পুরনো টিনশেড ভবনেই চলছে পাঠদান। নতুন ভবনে বিদ্যুৎ সংযোগের অজুহাতে ঠিকাদার খুলে নিয়েছেন পুরনো মিটার, ফলে গরমের দিনে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দমবন্ধ পরিস্থিতিতে ক্লাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিশুরা প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে। বারবার সময় নিলেও ঠিকাদার কাজ শেষ করছে না। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ভবন তৈরির অভিযোগও রয়েছে, কিন্তু কেউ দেখছে না।”
অগ্রগতি ধীর, অবহেলা স্পষ্ট
প্রকল্পের অগ্রগতি দেখে বোঝা যায়—কাশোরারচর ও বত্রিশ বিদ্যালয়ের কাজ কিছুটা এগিয়েছে। কিন্তু চৌধুরীহাটিতে কাজ অর্ধেক অবস্থায় থেমে আছে দীর্ঘদিন। জানা গেছে, এসব কাজের টেন্ডার হয়েছে সুনামগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আনোয়ার এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে। তবে বাস্তবে কাজ করছেন কিশোরগঞ্জের স্থানীয় ঠিকাদার শিবলি সাদিক।
অভিযোগের পরও প্রতিকার নেই
স্থানীয়দের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবেই ঠিকাদার ইচ্ছামতো কাজ করছেন। একাধিকবার লিখিত অভিযোগ ও তাগাদা দেওয়ার পরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ঠিকাদার শিবলি সাদিক বিলম্বের কথা স্বীকার করে বলেন, “বিভিন্ন কারণে কাজ দেরি হয়েছে। কাশোরারচর ও বত্রিশ বিদ্যালয়ের কাজ প্রায় শেষ, শিগগিরই হস্তান্তরের প্রস্তুতি চলছে। চৌধুরীহাটির কাজ শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে।”
কর্তৃপক্ষের অবস্থান
এলজিইডির সদর উপজেলা প্রকৌশলী মো. রাকিব উল হাফিজ জানান, “ঠিকাদারকে বিলম্বের বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কাজের অগ্রগতি তদারকি করা হচ্ছে।”
জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, “কাজগুলো উপজেলা পর্যায়ে টেন্ডার হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গাফিলতি প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব
অভিভাবকরা বলছেন, নতুন ভবন নির্মাণে গড়িমসি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে শিশুদের শিক্ষাজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিদ্যুৎবিহীন শ্রেণিকক্ষে গরমে অস্বস্তি, বৃষ্টির সময় পানি চুইয়ে পড়া, আর ঠাসাঠাসি করে বসে পড়াশোনা—এসব কারণে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ও উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ এখন জরুরি। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে ভবন নির্মাণ কাজ ঝুলে থাকায় আমরা অসহায় বোধ করছি।”
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবি
শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, সরকারি বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহার ও মানসম্পন্ন নির্মাণকাজ নিশ্চিত করতে হলে প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা এবং কঠোর তদারকি প্রয়োজন। অন্যথায় এমন দুর্ভোগ চলতেই থাকবে এবং শিক্ষার পরিবেশ আরও নষ্ট হবে।
Post a Comment