কিশোরগঞ্জে যুবদলের সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় দুই নেতা বহিষ্কার, জেলা কমিটিকে ব্যাখ্যা চাওয়ার নির্দেশ

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলাই এলাকায় যুবদলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় জেলা যুবদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দলীয় আদর্শ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তাদের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গত শুক্রবার (২২ আগস্ট) রাতেই যুবদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেলের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বহিষ্কৃতরা হলেন—কিশোরগঞ্জ জেলা যুবদলের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আলী আব্বাস এবং সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদুল হক।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দল স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তাদের ব্যক্তিগত কোনো অপকর্মের দায়ভার যুবদল বহন করবে না। পাশাপাশি স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সব নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে বহিষ্কৃত দুই নেতার সঙ্গে কোনো ধরনের সাংগঠনিক সম্পর্ক রাখা না হয়।

এ ঘটনায় শুধু বহিষ্কারই নয়, জেলা কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বকেও জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার সই করা আরেকটি পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে জেলা যুবদলের সভাপতি খশরুজ্জামান শরীফ এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, জেলা যুবদলের কয়েকজন নেতা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে দলের আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন—যা কেন্দ্রীয় কমিটির নজরে এসেছে। অথচ জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এ বিষয়ে কেন্দ্রকে সময়মতো অবহিত করা হয়নি। এতে সংগঠনের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে আগামী সাত দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সামনে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে জেলা নেতৃত্বকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা যুবদলের সভাপতি খশরুজ্জামান শরীফ গণমাধ্যমকে বলেন, “মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ সংঘর্ষের সূত্রপাত। তবে ঘটনার পরপরই আমরা কেন্দ্রকে জানিয়েছি। পরে কেন্দ্রীয় কমিটি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বহিষ্কারের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়েও জানানো হয়েছে, আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাখ্যা দেব।”

এদিকে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুন শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, সংঘর্ষে একজন নিহত হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে ঘটনাস্থল থেকে জড়িত সন্দেহে সাতজনকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার দুপুরে বৌলাই এলাকায় যুবদলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই বিরোধ শুরু হয়, যা দ্রুত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমরানুল হক হিমেল নামের এক তরুণ নিহত হন। সংঘর্ষের সময় অন্তত পাঁচটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া আরও কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। পরে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

এই ঘটনার পর থেকেই এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। স্থানীয়রা জানান, মাদক ব্যবসার প্রভাব ও রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব একত্র হয়ে এ ধরনের সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসী, যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে কিংবা লুটপাটের শিকার হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হলো স্থানীয় পর্যায়ে যুব সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা কতটা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বিশেষ করে মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া কেবল দলীয় ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং সামগ্রিকভাবে সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে।

অন্যদিকে যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘটনার পরপরই কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দ্রুত বহিষ্কার এবং জেলা নেতৃত্বকে জবাবদিহির আওতায় আনার মাধ্যমে তারা একটি বার্তা দিতে চাইছে যে, সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থেই এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তাদের অভিমত।

এখন দেখার বিষয়, জেলা নেতৃত্ব কী ধরনের ব্যাখ্যা দেয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটি পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেয়। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার ফলাফলও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

কিশোরগঞ্জের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনেও আলোচনার ঝড় উঠেছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যদি নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সামাল দিতে না পারে, তবে তারা কীভাবে জনগণের পাশে দাঁড়াবে?

Post a Comment

Previous Post Next Post