জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব
ভৈরব-আশুগঞ্জ সীমান্ত ঘেঁষা মেঘনা নদীর বুকে দিন-রাত অবাধে চলছে অবৈধ বালি উত্তোলন। স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লোডড্রেজারের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক লাখ ঘনফুট বালি তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে। এতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। অথচ এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে জাতীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে। বিশেষ করে দেশের অন্যতম বৃহৎ আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাতীয় গ্রিড লাইনের বিদ্যুৎ টাওয়ার এবং চর সোনারামপুর গ্রামের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।
নদীর বালু কেটে নেয়ায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশের মাটি দ্রুত ভেঙে পড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় ভৈরব-আশুগঞ্জ সেতুর নিকটবর্তী দুটি গ্রিড টাওয়ার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি ঘটলে আশুগঞ্জ থেকে উত্তরবঙ্গমুখী বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এতে শিল্পাঞ্চল, কলকারখানা থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামবে। পাশাপাশি চর সোনারামপুর গ্রাম হারিয়ে ঘরবাড়ি-জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বে শত শত পরিবার।
অবৈধ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ১০ থেকে ১২টি লোডড্রেজার সার্বক্ষণিক নদীতে বালি তোলায় ব্যস্ত। কোনো অনুমোদন ছাড়াই এই ড্রেজারগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় অবস্থান করে ২৪ ঘণ্টা ধরে বালি তুলছে। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এই অবৈধ ব্যবসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের বাধা দিলে হুমকি-ধামকির শিকার হতে হয়।
সরকারি প্রকল্পের আড়ালে বালি লুট
২০২৩ সালে মীর আক্তার কোং নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের জন্য মেঘনা নদী থেকে বালি উত্তোলনের অনুমতি পায়। প্রকল্পের আওতায় ৩৭ লাখ ঘনফুট বালি উত্তোলন করা হয়, যার জন্য ব্যয় হয়েছিল প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। তবে একই বছরের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর কোম্পানিটি তাদের কাজ বন্ধ করে দেয়।
এরপর থেকেই ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে একটি প্রভাবশালী চক্র অবৈধভাবে বালি উত্তোলন শুরু করে। মীর আক্তার কোং-এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিত বাবু জানান, বর্তমানে যারা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে বালি তুলছে তাদের সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, “আমাদের নামে কারা এভাবে অবৈধভাবে বালি তুলছে তা খোঁজ নিয়ে বের করা হবে এবং প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়দের উদ্বেগ
চর সোনারামপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন, “প্রতিদিন দেখি নদীতে বিশাল ড্রেজার দিয়ে বালি কেটে নিচ্ছে। আমাদের গ্রাম থেকে কয়েক’শ ফুট দূরে কাজ করছে তারা। এভাবে চলতে থাকলে নদী ভাঙনে আমাদের ঘরবাড়ি টিকবে না।”
স্থানীয় পরিবেশ কর্মী শফিকুল ইসলাম জানান, “মেঘনা নদীর এই অংশে বালি উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের কারণে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে জাতীয় স্থাপনা যেমন হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।”
জাতীয় স্বার্থে পদক্ষেপ জরুরি
বালি খেকোদের অবাধ দৌরাত্ম্য বন্ধে স্থানীয়রা সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। তারা মনে করেন, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ নির্ভর শিল্পায়ন ও অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
অন্যদিকে, চর সোনারামপুর গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকাও চরম ঝুঁকিতে। প্রতিনিয়ত নদীর পাড় ভেঙে বসতভিটা নদীতে বিলীন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বালি উত্তোলন বন্ধ করা ছাড়া বিকল্প নেই বলে জানান তারা।
Post a Comment