কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হোসেনপুর হাওরে অবস্থিত সাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদের মালিকানাধীন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’কে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতিতে তুমুল আলোচনা চলছে। অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির এক স্থানীয় শীর্ষ নেতা ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা গ্রহণ করে রিসোর্টটিকে রাজনৈতিক হামলা থেকে রক্ষা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় জনগণ এবং রাজনৈতিক মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
হামলার মধ্যে অক্ষত রিসোর্ট
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিক্ষুব্ধ জনতা ও ছাত্রসমাজ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালায়। কিশোরগঞ্জও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সেদিনের হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়ি, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বাড়ি এবং আবদুল হামিদের ভাতিজা শরীফ কামালের একটি রিসোর্ট ভাঙচুর করা হয়।
তবে আশ্চর্যের বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু থাকা হারুন অর রশিদের প্রেসিডেন্ট রিসোর্টটি অক্ষত থাকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কৃষকদের জমি দখল করে এই রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছিল, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরূপ মনোভাব রয়েছে।
টাকার বিনিময়ে নিরাপত্তা?
স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্রের দাবি, রিসোর্টটি রক্ষার জন্য মিঠামইন উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুল আলম জাহাঙ্গীর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার একটি চুক্তি করেছিলেন। উপজেলা যুবদলের ১ নম্বর সদস্য মাহফুজ আহমেদ সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, ৫ আগস্টের অল্প কিছুদিন পর হারুনের চাচা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমান ভূঞা এক ব্যাগ ভর্তি টাকা জাহিদুল আলমের খামারবাড়িতে পৌঁছে দেন। তিনি দাবি করেন, সেই সময় তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
মাহফুজের অভিযোগ, শুধু রিসোর্টই নয়, ওই টাকা নিয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আওয়ামী লীগের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও রক্ষা করেছেন।
স্থানীয়দের ক্ষোভ
এলাকার কৃষক ইসলাম উদ্দিন বলেন, “আমাদের জীবিকা কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। কিন্তু আমাদের জমি দখল করে এই রিসোর্ট বানানো হয়েছে। জমি হারানো কৃষকরা বহুবার কান্নাকাটি করেছেন, আল্লাহর কাছে বিচার চেয়েছেন। আমরা চাই, রিসোর্ট ভেঙে কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়া হোক।”
আরেক বাসিন্দা আফাজ মিয়া জানান, টাকা লেনদেনের গুঞ্জন বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মানুষকে রিসোর্টে হামলা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
ঘাগড়া ইউনিয়ন যুবদলের এক নেতা রাকিবের মতে, “আজ বিএনপির ভেতরে এমন কিছু লোক ঢুকে পড়েছে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করছে। ত্যাগী নেতাকর্মীরা উপেক্ষিত।”
গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-অর্থ সম্পাদক মুখলেছুর রহমান আকন্দ বলেন, “টাকা লেনদেনের খবর আমরা লোকমুখে শুনেছি। হয়তো এ কারণেই রিসোর্টে কোনো আক্রমণ হয়নি।”
জমি দখলের অভিযোগ
হোসেনপুর গ্রামের কৃষক দীলিপ চৌধুরী দাবি করেন, তার ১ একর ১০ শতাংশ জমি বিনা অনুমতিতে দখল করা হয়েছে এবং বিনিময়ে কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি। মানিক মিয়া নামে আরেক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তার ৫ একর জমির জন্য ৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো অর্থ তিনি পাননি।
অভিযুক্তদের বক্তব্য
জমি দখল ও অর্থ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হারুনের চাচা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমান ভূঞা। তিনি বলেন, “আমি নিজেই মামলার আসামি এবং জেল খেটেছি। রিসোর্ট রক্ষায় টাকা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুল আলম জাহাঙ্গীরও অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। যে টাকা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার প্রমাণ দিতে হবে।”
নতুনভাবে চালু রিসোর্ট
সম্প্রতি জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট রিসোর্টটি ‘মাওলা আলী ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাছ থেকে তিন বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। গত ৮ আগস্ট থেকে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে ১৬ জন কর্মী রিসোর্টের পরিচ্ছন্নতা ও সংস্কারের কাজ করছেন। তবে ইজারার অর্থমূল্য প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
শেষকথা
রিসোর্ট রক্ষায় কোটি টাকার চুক্তির অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও বিষয়টি কিশোরগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জমি দখল, অর্থ লেনদেন এবং রাজনৈতিক আঁতাতের অভিযোগে স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ। অনেকেই মনে করছেন, এ ঘটনায় যদি সঠিক তদন্ত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রভাবশালী স্থাপনা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে।
Post a Comment