কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনে রাজনীতির মাঠ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এক সময় আওয়ামী লীগের দৃঢ় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে এখন নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনীতির ভিন্নধারার উত্থান স্থানীয় রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা দলীয় কার্যালয়গুলো পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে, নেতাকর্মীরা নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন মিছিল-মিটিং, পথসভা ও উঠান বৈঠকে। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ভোটের বাইরে থাকা ভোটাররা এখন নতুন করে আশাবাদী—ফিরে পেতে পারেন গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভোটাধিকার।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর বাজিতপুর-নিকলী আসনটি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেই সময় থেকেই শুরু হয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা ও ধরপাকড়ের অভিযোগ। অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন, কেউ কেউ রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়েন। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী যেমন রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ ওঠে, তেমনি কিশোরগঞ্জ-৫ আসনেও শুরু হয় বিরোধী দলগুলোর পুনঃসংগঠনের প্রক্রিয়া।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ব্যস্ততা বেড়েছে। বাজিতপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও জেলা সহসভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ইকবাল সোজাসাপটা বলেন, “আমি মনোনয়নপ্রত্যাশী নই, আমি মনোনয়নপ্রাপ্ত। এখনো দলের পক্ষ থেকে আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়নি।”
অপরদিকে, বাজিতপুর পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মেয়র এহসান কুফিয়া বলেন, “গত ১৭ বছর ধরে দলীয় নিপীড়নের মধ্যে থেকেও দলের সঙ্গে ছিলাম। দল নিশ্চয়ই আমার অবদান বিবেচনায় নেবে।”
নির্বাচনি সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ১২ দলীয় জোট। জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। জানা গেছে, বিএনপির স্থানীয় নেতারাও তার প্রচারণাকে সহযোগিতা করছেন।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং জাতীয় ঐকমত্য গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়া প্রয়াত সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মামুন, প্রবীণ বিএনপি নেতা মীর মো. জলিল, সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা শফিকুল আলম রাজন, এবং জেলা বিএনপির সদস্য মো. বদরুল আলম শিপু—এরা প্রত্যেকেই রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
নিকলীতে প্রয়াত তিনবারের সংসদ সদস্য আমির উদ্দিন আহমেদের ছেলে এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট বদরুল মোমেন মিঠুও নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাজিতপুরে আলোচনায় রয়েছেন সাবেক সচিব আব্দুল ওয়াহাব, যিনি বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে পরিচিত।
জামায়াতের ঘরোয়া সংগঠনে গতি
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কিশোরগঞ্জ জেলা আমির অধ্যাপক মো. রমজান আলীকে প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি দুই উপজেলা—বাজিতপুর ও নিকলীতেই নিয়মিত গণসংযোগ চালাচ্ছেন এবং স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মাঠে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময় ধরে দখলে রাখা আসনে বিএনপি-জামায়াত ও শরিকদের পুনরায় উত্থান রাজনীতির জন্য একটি বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর এই পুনরুত্থান কেবল নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই নয়, বরং দীর্ঘ রাজনৈতিক বঞ্চনা, দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচনের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কিশোরগঞ্জ-৫ আসন এখন একটি হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এখানে নির্বাচনের ফলাফল কেবল একটি আসনের ব্যবধান নির্ধারণ করবে না, বরং তা জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। যে কারণে দেশের প্রধান দুটি জোটই এ আসনটিকে ঘিরে কৌশলগত গুরুত্ব দিচ্ছে।
জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এই আসনের সাধারণ মানুষকে রাজনীতিতে নতুন করে সম্পৃক্ত করেছে। এখন দেখার বিষয়—এই রাজনৈতিক উত্তেজনা নির্বাচনের দিকে শান্তিপূর্ণভাবে মোড় নেয়, নাকি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মাঠের লড়াই।
Post a Comment