পবিত্রতা, ইতিহাস আর বিশ্বাসের এক অনন্য মেলবন্ধন—পাগলা মসজিদ
কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে নরসুন্দা নদীর তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাগলা মসজিদ আজ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে হাজারো মানুষের মানসিক ও আত্মিক নির্ভরতার স্থান। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও বিশ্বাস করেন, এখানে দান-খয়রাত কিংবা নফল নামাজ আদায়ের মাধ্যমে পূরণ হয় মনোবাসনা।
প্রাচীন এই মসজিদকে ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। ইতিহাস অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় আড়াই শতাব্দী আগে এক পাগলবেশী আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নরসুন্দা নদীতে মাদুর বিছিয়ে ভেসে এসে বর্তমান পাগলা মসজিদের স্থানে অবস্থান নেন। তার পবিত্রতা ও অলৌকিকত্বে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ সেখানে জড়ো হতে শুরু করে। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পর সেই স্থানেই নির্মিত হয় বর্তমান মসজিদটি।
আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও প্রার্থনার মিলনস্থল
মসজিদটিকে ঘিরে মানুষের এমন একটি দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে—যে কেউ এখানে এসে দান করলে অথবা আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করলে তার মনোবাসনা পূরণ হয়। অনেকেই নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, পশু-পাখি এমনকি কোরআন শরীফ, আগরবাতি, মোমবাতি দান করেন। বিশেষ করে শুক্রবার দিনটিতে মসজিদ প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে। এসময় আশপাশের এলাকাজুড়ে দেখা দেয় যানজটসহ নানা জনজট।
আধুনিক স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
পাগলা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি স্থাপত্যিক সৌন্দর্যেরও অনন্য নিদর্শন। তিনতলা বিশিষ্ট এই মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ এবং পাঁচতলা সমান একটি মিনার। প্রায় ৩ একর ৮৮ শতাংশ জমির উপর নির্মিত মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় ৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। নারীদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা থাকাও এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
এটি কিশোরগঞ্জ জেলার গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, আধুনিক সদর হাসপাতাল এবং নরসুন্দা নদীর সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ায় সহজেই দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের নজরে আসে।
বিপুল পরিমাণ দানের রেকর্ড
পাগলা মসজিদে দানবাক্স খোলার প্রতিবারেই তৈরি হয় চমকপ্রদ রেকর্ড। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দানবাক্স থেকে উত্তোলন করা হয় ৬ কোটি ৩২ লাখ ৫১ হাজার টাকার বেশি। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে পাওয়া যায় ৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকারও বেশি নগদ অর্থ, সঙ্গে ছিল বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার।
এই বিপুল দান প্রমাণ করে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস কতটা গভীরভাবে প্রোথিত এ মসজিদটির প্রতি।
বিশ্বাস বনাম শরীয়ত: দান নিয়ে আলেমদের ভিন্নমত
পাগলা মসজিদে দান করা এবং এর মাধ্যমে ইচ্ছা পূরণের যে বিশ্বাস, তা নিয়ে আলেমদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ মনে করেন, মসজিদে দান একটি নেক কাজ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। তবে তারা বলেন, শুধুমাত্র পাগলা মসজিদে দান করলেই মনোবাসনা পূরণ হবে—এই ধারণাটি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌক্তিক নয়।
অন্যদিকে, আরও একাংশ আলেম এ বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, দানের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ না থেকে সার্বজনীন হওয়া উচিত।
সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য উন্মুক্ত একটি পবিত্র স্থান
এ মসজিদে মুসলিম ছাড়াও হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও নিয়মিত আসেন মানত কিংবা মানসিক প্রশান্তির উদ্দেশ্যে। এমন আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ আজকের দিনে খুবই বিরল। এখানকার পরিবেশ, আধ্যাত্মিক আবহ এবং মানুষের নিঃস্বার্থ দানের প্রবণতা একে একটি অনন্য পর্যটন ও তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।#পাগলামসজিদ #কিশোরগঞ্জ #দান #মানত #ইসলামিকস্পিরিচুয়ালস্পট
Post a Comment