ঘোড়ায় চড়ে কবর খোঁড়ার যাত্রা শেষ: চলে গেলেন কিশোরগঞ্জের মানবিক গোরখোদক মনু মিয়া

কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগা পাড়া গ্রামের পরিচিত মুখ, মানবিক সেবার জীবন্ত প্রতীক গোরখোদক মনু মিয়া আর নেই। শনিবার (২৮ জুন) সকাল ১০টা ২০ মিনিটে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহানুভব মানুষটি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কবর খুঁড়ে যাওয়া মনু মিয়া ছিলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এক হাতে কোদাল, আরেক হাতে নিঃস্বার্থ সেবার অঙ্গীকার নিয়ে তিনি টানা ৪৯ বছর কবর খুঁড়েছেন মানুষের শেষ ঠিকানা তৈরির জন্য। জীবদ্দশায় তিনি ৩ হাজার ৫৭টি কবর খনন করেছেন—তাও বিনামূল্যে, কোনো পারিশ্রমিক কিংবা বখশিশ না নিয়ে।

ঘোড়ায় চড়ে মানুষের পাশে

বিষণ্ন সময়ের পাশে দাঁড়াতে মনু মিয়া শুধু কোদাল হাতে ছুটে আসতেন না, তার ছিল এক আশ্চর্য বাহন—একটি ঘোড়া। নিজের ধানক্ষেত বিক্রি করে তিনি কিনেছিলেন এই ঘোড়াটি, যাতে সহজে ও দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে পারেন। ঘোড়ার পিঠে তুলে নিতেন সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, এরপর ছুটে যেতেন দূর-দূরান্তের গ্রামে, মানুষের দাফনের কাজ সারতে। একে কেউ দায়িত্ব বলেন, কেউবা পাগলামি—কিন্তু মনু মিয়ার চোখে এটি ছিল একান্ত মানবিক কর্তব্য।

অর্থ নয়, ভালোবাসাই ছিল মূল পাথেয়

এ সমাজে যেখানে অনেক কিছুই অর্থের বিনিময়ে হয়, সেখানে মনু মিয়া যেন ছিলেন ব্যতিক্রম এক চরিত্র। তার জীবনের মূল দর্শন ছিল, মৃত্যুর পর একজন মানুষ যেন সম্মানের সঙ্গে শেষ গন্তব্যে পৌঁছান। এজন্য তিনি কখনো অর্থ চাইলেন না, বরং বিপরীতে ধন্যবাদ ও দোয়া পেতেই বেশি আনন্দ পেতেন।

স্থানীয়দের কাছে তিনি শুধু একজন গোরখোদক ছিলেন না, ছিলেন একজন ‘মানুষের মানুষ’। যারা জীবনে তাকে কাছে পেয়েছেন, তারা জানেন মনু মিয়ার মুখে সব সময় একটা শান্ত স্নিগ্ধ হাসি থাকত। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

গ্রামীণ সমাজে মনু মিয়ার প্রভাব

ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন এলাকার বহু মানুষই তাকে এক নামে চিনতেন। বিশেষ করে দুঃসময়ে যখন কেউ এগিয়ে আসে না, তখন মনু মিয়া থাকতেন সবার আগে। তার এই অবদান অনেকে অনুভব করলেও কখনো যথাযথভাবে মূল্যায়ন হয়নি। অথচ এমন মানুষরা সমাজের অন্ধকার সময়গুলোতে আলো হয়ে ওঠেন।

শেষ বিদায়

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তার জানাজা ও দাফনের আয়োজন করা হয়েছে নিজ গ্রাম আলগা পারায়। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করছেন।


---

🔚 মনু মিয়ার রেখে যাওয়া শিক্ষা

মনু মিয়ার জীবন আমাদের শেখায়, সেবার জন্য বড় পদ কিংবা সম্পদের দরকার নেই—প্রয়োজন শুধু একটা মানবিক মনোভাব। তার মতো মানুষেরা থাকেন বলেই সমাজ এখনো কিছুটা আলোর মুখ দেখে। আমাদের দরকার এমন আরও অনেক মনু মিয়া—যারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন, অর্থ নয় বরং ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post