ভৈরব কুলিয়ারচরে ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকা তৈরির কারিগররা

জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব

বর্ষা এলেই কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও কুলিয়ারচরের গ্রামীণ জনপদে নৌকার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। নদ-নদী আর খাল-বিলে পানি বেড়ে যাওয়ায় যোগাযোগ, মাছ ধরা ও গবাদিপশুর খাদ্য সংগ্রহের জন্য প্রয়োজন পড়ে ছোট-বড় নৌকার। এই মৌসুমে কুলিয়ারচরের ছয়সুতি ও ভৈরবের শিমুলকান্দি এলাকায় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি ও মহাজনরা। এর ফলে অনেকের আয়-রোজগারের পথও খুলে যায়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছয়সুতি ও শিমুলকান্দির কর্মশালাগুলোতে বিভিন্ন আকার-আকৃতির কাঠের নৌকা তৈরি হচ্ছে। একেকটি নৌকার দাম নির্ভর করে তার আকারের ওপর, যা ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমনকি ৩০ থেকে ৫০ হাত লম্বা নৌকার দাম লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

বর্ষায় গ্রামের অনেক জায়গায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে ঘর থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় নৌকা। ফলে চলাচলের পাশাপাশি জীবিকার প্রয়োজনেও নৌকার ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার কিংবা হাসপাতালে যেতেও ব্যবহার করতে হয় এই নৌকা। কেউ এটি ব্যবহার করেন যাত্রী পারাপারে, কেউবা মাছ ধরতে কিংবা ঘাস সংগ্রহে। অনেকেই আবার এই মৌসুমে নৌকা চালিয়ে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা আয় করছেন।

এলাকার বাসিন্দা রহমত উল্লাহ জানান, বর্ষার আগে থেকেই মহাজনরা কোষা ডিঙি বানানো শুরু করেন। বর্ষার পানিতে এসব নৌকার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তিনি বলেন, “নৌকা ছাড়া বর্ষায় চলাফেরা সম্ভব না—চিকিৎসা নিতে হলেও নৌকা লাগে।”

আগানগরের মাঝি আনোয়ার হোসেন বলেন, “বর্ষায় খালপাড় দিয়ে যাতায়াত করা যায় না, তাই আগেভাগেই ৫-৬ হাজার টাকায় নৌকা কিনে ফেলি।” এই নৌকা দিয়েই তিনি প্রতিদিন শতাধিক টাকা আয় করছেন।

মাছ শিকারি রহমত ব্যাপারীর অভিজ্ঞতাও একই। বর্ষার সময় ঘরের চারপাশে পানি জমে যাওয়ায় মাছ ধরাই হয়ে ওঠে তার আয়ের মূল উৎস। তিনি বলেন, “নৌকা ছাড়া মাছ ধরা যায় না, আর মাছ বিক্রির টাকাতেই চলে সংসার।”

নৌকা তৈরির খরচ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মহাজন রইস উদ্দিন জানান, কাঠসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না। আগে প্রতিটি নৌকায় ২-৩ হাজার টাকা লাভ হতো, এখন তা অনেক কমে গেছে। তবুও দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে দিতে পারছেন না তিনি। এক সিজনে তার আয় হয় প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা।

কারিগর রমেশ বর্মণ বলেন, “একটা নৌকা বানাতে সময় লাগে ৫-৬ দিন। একজন কারিগর মাসে ৪-৫টা নৌকা তৈরি করতে পারেন।” মজুরি হিসেবে প্রতি মাসে তার আয় হয় ২০-২২ হাজার টাকা।

কারিগর সুধন চন্দ্র বলেন, “বর্ষার মৌসুমে কাজের চাপ বেশি থাকে। প্রতিদিন ৮০০-৯০০ টাকা মজুরি পাই। অন্য সময় অন্য পেশায় কাজ করি।”

আরেকজন মহাজন হামিদ মিয়া জানান, নৌকার আকার অনুযায়ী দাম নেয়া হয় ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা পর্যন্ত। বর্ষা মৌসুমে তিনি মাসে অন্তত ২০-৩০টি নৌকা বিক্রি করেন, যার মাধ্যমে প্রায় এক লাখ টাকার বিক্রি হয়। এতে করে তার প্রতি মাসে লাভ হয় ২০-২৫ হাজার টাকা। এখানকার তৈরি নৌকা শুধু স্থানীয় চাহিদা নয়, বরং নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ আশপাশের জেলাতেও সরবরাহ করা হয়। আর মৌসুম শেষে তারা ফের কাঠের আসবাবপত্র তৈরির পেশায় ফিরে যান।

গ্রামীণ জীবনের অনিবার্য অংশ নৌকা

বর্ষাকালে ভৈরব ও কুলিয়ারচরের মানুষদের জীবন-জীবিকা, যাতায়াত, এমনকি চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রেও নৌকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীবিকার অনুসন্ধানে যখন নদীতে নামেন কেউ, তখন এই নৌকাই তাদের উপার্জনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। আর এই চাহিদাই ঘুরিয়ে দেয় গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা।#ভৈরব #কুলিয়ারচর #নৌকা_শিল্প #বর্ষা #গ্রামীণ_জীবন #বাংলাদেশ_গ্রাম

Post a Comment

Previous Post Next Post