টাকা ছাড়া সরকারি গুদামে ঠাঁই মেলে না ধানের, দুর্নীতির ফাঁদে অষ্টগ্রামের কৃষকরা

অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) থেকে:
সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে গিয়ে একাধিক বাধা ও দুর্নীতির চক্রে আটকা পড়ছেন কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার কৃষকরা। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি খাদ্য গুদামে ধান জমা দিতে হলে ঘুষ গুনতে হচ্ছে প্রতি টনে দুই হাজার টাকা করে। এ ছাড়াও ওজনে কারচুপি, কাগজ প্রস্তুতের নামে অবৈধ অর্থ আদায় এবং প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার মতো চাঞ্চল্যকর অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।

এই দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে এক ভিডিও ফুটেজে, যেখানে সরাসরি দেখা যায় খাদ্য পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন ভূইয়া প্রতি টন ধানের জন্য ঘুষ দাবি করছেন। সরকার যেখানে প্রতিমণ ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১,৪৪০ টাকা, সেখানে কর্মকর্তা নিজের পকেট ভারী করতে কৃষকদের কাছ থেকে তিন ভাগের একভাগ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।

ওজনের ফাঁদ:
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মণ ধান মানে ৪০ কেজি, কিন্তু গুদামে তা গ্রহণ করা হচ্ছে ৪২ কেজি হিসেবে। এতে প্রতি টনে কৃষকদের গচ্চা যাচ্ছে প্রায় ৯০০ টাকা। এটি এক ধরনের প্রতারণা যা কৃষকদের ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

ফরমালিন ছাড়াই শুকনো ধান ‘ভেজা’!
কৃষকদের অভিযোগ, ধান জমা দিতে গেলে কর্মকর্তারা ধানকে ‘ভেজা’ বলে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার পর সেই ধানই ‘ঠিকঠাক’ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ। কেউ কেউ বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তা ঘুষ ও খরচ মিটিয়ে আর থাকে না।

কাগজ তৈরিতে 'লুঙ্গি অফিসার'র বাণিজ্য:
গুদামের প্রহরী শাহ আলম কাগজ প্রস্তুতের জন্য প্রতি টনে নিচ্ছেন ২৭০ টাকা। তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে লুঙ্গি পরে অফিস করেন এবং সাংবাদিক প্রশ্ন করলে উত্তেজিত হয়ে গালিগালাজ ও মোবাইল ছুড়ে মারেন। এক কথায়, সরকারি অফিস যেন রীতিমতো ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

তালিকায় জালিয়াতি, কৃষক বঞ্চিত:
প্রকৃত কৃষকরা যেখানে ধান বিক্রি করতে পারছেন না, সেখানে অন্য কেউ তাদের নামে ধান দিয়ে দিচ্ছে। একাধিক কৃষক অভিযোগ করেছেন, তারা নিজেরা ধান দিতে পারেননি, অথচ তাদের নামের কার্ডে কেউ স্লিপ ইস্যু করেছে। বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ হলেও প্রাথমিকভাবে এটি দুর্নীতির আরেকটি বড় উদাহরণ।

মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা ও হিসাব:
এই মৌসুমে অষ্টগ্রাম গুদামে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১,৭৯৫ টন। এর ৯৮ শতাংশ ইতোমধ্যে সংগ্রহ শেষ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘুষ ও অনিয়মের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রহরীর পকেটে গেছে প্রায় ১০ লাখ টাকা।

কৃষকদের বক্তব্য:
মাজহারুল ইসলাম নামের এক কৃষক বলেন, “আমার ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি ছিল না, তবুও তা নেয়নি। কিন্তু পাশের জনের একই ধরনের ধান গ্রহণ করা হয়েছে। আমি ঘুষ না দেওয়ায় তারা আমার ধান নেয়নি।”

কৃষক শামসুল হক বলেন, “সব খরচ শেষে মনে হয় বাজারদরেই ধান বিক্রি করা ভালো। সরকারি গুদামে ধান দিতে গেলেই শুধু হয়রানি আর ঘুষের দাবির মুখে পড়তে হয়।”

আরেকজন কৃষক ইয়াসিন মিয়া বলেন, “আমার শুকানো ধান বলে তারা নেয়নি, অথচ যাদের ধান ভালোভাবে শুকায়নি, তাদের ধান নিয়েছে। পরে বুঝেছি, টাকা দিলে সব ঠিক হয়ে যায়।”

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া:
অভিযুক্ত পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন ভূইয়া অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং ভিডিওকে ‘এডিট করা’ বলে দাবি করেছেন। তিনি কৃষকদের তালিকাও দিতে অস্বীকৃতি জানান।

এ বিষয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. দিলশাদ জাহান বলেন, “বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে এবং অভিযোগ সত্য হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কিশোরগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আলমগীর কবির জানান, “কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে এবং কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

দাবি জনমত:
স্থানীয় কৃষক ও সচেতন মহল দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, এই অনিয়ম বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহ হারাবে এবং এর প্রভাব পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর।

Post a Comment

Previous Post Next Post