আজ শহীদ আরমান দিবস

কিশোরগঞ্জ: আবু ইউসুফ সোহাগ 
বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মীয় আন্দোলনের পটভূমিতে শহীদ কিশোর আরমানের নাম আজও অনেকের হৃদয়ে গেঁথে আছে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইসলাম ও কুরআনের সম্মান রক্ষায় রাজপথে নেমে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিল এই কিশোর। ১৯৯৪ সালের ৩০ জুন, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ধর্মবিদ্বেষী মন্তব্যের প্রতিবাদে আন্দোলনে ফুঁসছিল, তখন কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরমানও সেই প্রতিবাদের অংশ হয়েছিল।

তৎকালীন সময়ে তসলিমা নাসরিনের লেখা ও বক্তব্যে পবিত্র কুরআন ও ইসলাম ধর্মের প্রতি চরম অবমাননার অভিযোগ ওঠে, যা সারাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় নেতারা হরতাল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি আহ্বান করেন। কিশোরগঞ্জেও সেই ডাকে ব্যাপক সাড়া পড়ে।

সেদিন ছিলো এক শুক্রবার। ভোরবেলা ফজরের আজান শুনেই ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সবাইকে নামাজে ডাকেন আরমান। নামাজ শেষে সে মাকে বলে, "আম্মু, আমি আজ মিছিলে যাব, একটু নাস্তা দাও।" মায়ের কাঁপা কণ্ঠে জবাব, "বাবা, তুই এখনো ছোট। মিছিলে যেতে হবে না। ঝুঁকি আছে।" কিন্তু আরমানের মন স্থির—সে জানত, এই মিছিল কেবল প্রতিবাদ নয়, বরং ঈমান রক্ষার লড়াই।

তার বন্ধুদের বেশিরভাগই কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিল। হাদীস শিক্ষকের কাছ থেকে সে জেনেছিল, ইসলামের সম্মান রক্ষায় যারা জীবন দেয়, তারা শহীদের মর্যাদা পায়। এই বিশ্বাসেই সে মিছিলে অংশ নেয়। কিন্তু সেই মিছিলই হয়ে যায় তার জীবনের শেষ পথচলা। পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে দুপুরের দিকে বাড়ি ফেরে নিথর দেহে।

আরমানের মৃত্যুর খবর মুহূর্তেই কিশোরগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন তার জানাজায় শোকে আচ্ছন্ন হাজারো মানুষের ঢল নামে শহরে। নামাজে অংশ নেন দেশের বিশিষ্ট আলেমগণ—আল্লামা ফজলুল হক আমিনী (রহ.), আল্লামা মহিউদ্দিন খান (রহ.), মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.) সহ অনেক ইসলামপ্রিয় নেতা। জানাজায় ইমামতি করেন আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ। দাফনের সময় আরমানের রক্তমাখা শরীরকে গোসল না দিয়েই তাকে সমাহিত করা হয়—তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।

ছোটবেলা থেকেই আরমান ছিল নামাজি ও নীতিবান। স্কুলে নামাজের জায়গা না থাকায় সহপাঠীদের নিয়ে আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করে সে, যা তার ধর্মীয় দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে। তার জীবনযাপন, চিন্তা ও মননে ইসলাম ছিল মূল চালিকা শক্তি।

আজ ৩০ জুন, শহীদ আরমান দিবসে বাংলাদেশ আবারও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে এই সাহসী কিশোরকে, যিনি শিশু বয়সেই বুঝেছিলেন—ঈমান রক্ষার জন্য কখনো কখনো রাজপথে নামতে হয়। তার আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি নিষ্ঠা ও সাহস কেবল বড়দের নয়, কিশোরদের মাঝেও গড়ে উঠতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post