কৃষ্ণচূড়ায় সেজেছে কিশোরগঞ্জ শহরের রাজধানী খ্যাত মুক্তমঞ্চ

স্টাফ রিপোর্টার;হালিমাতুস সাদিয়া 
গ্রীষ্মের খরতাপে যখন প্রকৃতি ক্লান্ত, তখন কিশোরগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মুক্তমঞ্চ রূপ নিয়েছে এক রঙিন স্বপ্নে। কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল ছটায় ঢেকে গেছে চারপাশ। প্রাণবন্ত এই দৃশ্য অবলোকন করতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় জমাচ্ছেন কিশোরগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে আশেপাশের উপজেলার দর্শনার্থীরা।

নরসুন্দা নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা ‘নরসুন্দা লেকসিটি’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই মুক্তমঞ্চটির সৌন্দর্য আজ সকলের মন জয় করেছে। বিশেষ করে বৈশাখের মাঝামাঝি সময়ে কৃষ্ণচূড়ার রঙিন উচ্ছ্বাস যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের মিলন ঘটিয়েছে। একদিকে গাছে গাছে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া, অন্যদিকে ঝরে পড়া লাল পাপড়ির গালিচা—সব মিলিয়ে এক অপরূপ চিত্রপটের সৃষ্টি হয়েছে।

২০১২ সালে প্রায় ১০৬ কোটি টাকার নরসুন্দা নদী পুনর্খনন ও সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১৬ সালে সেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয় এবং নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠে এই মুক্তমঞ্চ। প্রকৃতিপ্রেমীদের উদ্যোগে এখানে লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো আজ শহরের অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

গুরুদয়াল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শরীফ আহমেদ জানান, “আগেও ফুল ফুটতো, তবে এবার ফুলের পরিমাণ চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে ছবি তুলতে আসে, প্রকৃতি উপভোগ করে।”

শহরের বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও তরুণ-তরুণীরা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তমঞ্চের কৃষ্ণচূড়া ফুলে মোড়ানো ছবি শেয়ার করছেন। ফটোগ্রাফার নাজমুস সাকিব জানান, “এ বছর ক্যামেরার ফ্রেমে লাল ও সবুজের সংমিশ্রণ দারুণ এসেছে। অনেকেই তাদের প্রোফাইল ছবি হিসেবে এসব মুহূর্ত ব্যবহার করছে।”

তবে মুক্তমঞ্চের এই সৌন্দর্যের মাঝে কিছু নেতিবাচক দিকও চোখে পড়ছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, নরসুন্দা নদীর পানি দিনদিন দূষিত হয়ে পড়ছে, চারপাশে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। এতে পরিবেশ এবং ফুলগাছের আশপাশের সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বেড়াতে আসা রাসেল আহমেদ বলেন, “পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে ভালো লাগছে। তবে নদীটি যদি পরিষ্কার থাকতো তাহলে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠতো।”

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘রূপান্তরের তারুণ্য’-এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ এনামুল হক হৃদয় জানান, “আমরাই কিছু কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছিলাম। সেগুলো এখন বড় হয়ে ফুলে ভরে গেছে। ভবিষ্যতে আরও গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেব।”

গুরুদয়াল কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মো. মতিউর রহমান বলেন, “এই সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলেরই সচেতনতা প্রয়োজন। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও দায়িত্ব নিতে হবে।”

কবি মেহেরুন নেসা ভূঁইয়া বলেন, “কৃষ্ণচূড়া আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এর লালিমা কবি-সাহিত্যিকদের বারবার আলোড়িত করেছে। প্রকৃতির এই নিদর্শন অনুভূতির গভীরে নাড়া দেয়।”

উদ্ভিদবিদ গাজী মো. আশরাফুল আলম বলেন, “কৃষ্ণচূড়া শুধু শোভাময় নয়, এটি পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীষ্মের মাঝেও ছায়া দেয়, পাখির বাসা হিসেবে কাজ করে এবং আয়ুর্বেদিক গুণেও সমৃদ্ধ।”

এই কৃষ্ণচূড়ায় রাঙানো মুক্তমঞ্চ যেন হয়ে উঠেছে প্রকৃতির মাঝে এক মানবিক মিলনস্থল। শহুরে ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি ভুলে মানুষ এখানে আসছে প্রশান্তির খোঁজে। যদি সবার সম্মিলিত উদ্যোগে নদী ও পরিবেশ রক্ষা করা যায়, তবে এই মুক্তমঞ্চ আরও দীর্ঘদিন ধরে তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের মাঝে।

Post a Comment

Previous Post Next Post