হাওরে গাছের অভাব, বজ্রপাতে বাড়ছে প্রাণহানি: কৃষকরা চরম ঝুঁকিতে

কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। চলতি বছরের গত ২৩ দিনের ব্যবধানে জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪ জন। নিহতদের অধিকাংশই কৃষক ও খোলা জায়গায় কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরের মতো উন্মুক্ত এলাকায় গাছপালা না থাকায় বজ্রপাতের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়েছে।

বিগত কয়েক দশকে কিশোরগঞ্জে ব্যাপকহারে গাছ কাটা ও বৃক্ষহীনতার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেড়েছে তাপমাত্রা, যার অন্যতম ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা দিয়েছে ঘনঘন বজ্রপাত। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং বর্ষাকালের সময়কাল দীর্ঘ হওয়াও বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, হাওরে কর্মরত মানুষ প্রায়শই খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে বাধ্য হন, বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে। এ সময় বজ্রপাত হলে তা সরাসরি মানুষের শরীরে আঘাত হানে, যা মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পুরো জেলায় বজ্রপাত প্রতিরোধে ব্যবহৃত লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক যন্ত্র রয়েছে মাত্র ২৫টি, যা এই বিপুল হাওর এলাকায় অত্যন্ত অপ্রতুল। তাছাড়া দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও তা মূলত লোকালয় কেন্দ্রিক, হাওরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ধরনের আশ্রয়কেন্দ্রের অস্তিত্ব নেই।

সাম্প্রতিক বজ্রপাতের ঘটনায় যেসব ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

২১ এপ্রিল পাকুন্দিয়ার চরকাওনা এলাকায় আবু তাহের মিয়া (৫০), একজন রাজনৈতিক কর্মী বজ্রপাতে নিহত হন।

২৮ এপ্রিল মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে পৃথক বজ্রপাতে নিহত হন ফুলেছা বেগম, ইন্দ্রজিত দাস ও স্বাধীন মিয়া, যাঁরা সবাই হাওরে ধান কাটার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।

একই দিনে বাজিতপুর, কটিয়াদী, ইটনা ও পাকুন্দিয়ায় আরও চারজন কৃষক ও জেলে বজ্রপাতে প্রাণ হারান।

৬ মে পাকুন্দিয়ায় দুই স্কুলছাত্রী ও একজন কৃষকের মৃত্যু হয় বজ্রপাতের কারণে।

১১ মে ভৈরব ও কুলিয়ারচরে নিহত হন আরও তিন কৃষক, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কলেজশিক্ষার্থী।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কিশোরগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, “হাওরে আগে প্রচুর গাছ ছিল। গাছ কেটে ফেলার ফলে প্রাকৃতিক সুরক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব বজ্রপাতের মত বিপদজনক দুর্যোগে পড়ছে। ব্যাপক বৃক্ষরোপণ, প্রযুক্তিনির্ভর সতর্কতা এবং প্রশাসনিক উদ্যোগ ছাড়া এই অবস্থা কাটানো যাবে না।”

আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিকলী শাখার সিনিয়র পর্যবেক্ষক আখতার ফারুক বলেন, “বর্তমানে বজ্রপাতের সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে হাওরে থাকা কৃষক বা শ্রমিকদের জন্য তাৎক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।”

জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. বদরুদ্দোজা জানিয়েছেন, বজ্রপাতে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি জানান, বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়দের মতে, এই পরিস্থিতি উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন:

হাওরে পর্যাপ্ত বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপন।

দ্রুত-প্রতিসংবাদ সক্ষম আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা চালু।

বৃক্ষরোপণ অভিযান জোরদার করা।

কৃষকদের জন্য দুর্যোগকেন্দ্র নির্মাণ।

সচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা।


দেশের অন্যতম খাদ্য উৎপাদন এলাকা হিসেবে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। কৃষক ও হাওরবাসীদের জীবন রক্ষায় এখনই সময় প্রকৃতিনির্ভর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। নইলে এই মৃত্যু মিছিল থামবে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post