এক সময়ের অপ্রয়োজনীয়, পরিত্যক্ত চুল আজ কিশোরগঞ্জের ভৈরব অঞ্চলের মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে নতুন আশার আলো। নারীদের ফেলে দেওয়া চুলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি লাভজনক রপ্তানি শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে এই অভিনব ব্যবসা।
ভৈরবে বর্তমানে একাধিক চুল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শত শত ফেরিওয়ালা প্রতিদিন গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ঘুরে নারীদের ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করছেন। বিনিময়ে তারা দেন প্রসাধনী, শিশু খাদ্য কিংবা প্লাস্টিকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এভাবে অনেকে নিয়মিত আয় করছেন।
চুল সংগ্রহকারীরা দিনে গড়ে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম চুল সংগ্রহ করেন। কেউ কেউ আরও বেশি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। সংগৃহীত চুল বিক্রি করে একজন ফেরিওয়ালা দৈনিক ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। চুলের বর্তমান বাজারদর প্রতি কেজিতে ৫,৫০০ থেকে ৬,৫০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।
চুল সংগ্রহের পর এগুলো বিক্রি করা হয় স্থানীয় মহাজনদের কাছে। মহাজনরা চুল একত্র করে মাসে একবার ঢাকাসহ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। সেখান থেকে চুল রপ্তানি হয় বিদেশে—বিশেষত চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ব্যাংককে। এসব দেশে চুল ব্যবহার হয় পরচুলা বা উইগ তৈরির কাঁচামাল হিসেবে।
বিশ্ববাজারে মানব চুলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত, কেমোথেরাপি গ্রহণকারী ক্যানসার রোগী, সৌন্দর্যসচেতন নারী এবং বিনোদন শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে এসব পরচুলা ব্যবহৃত হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে মানব চুলের দাম বেশ চড়া এবং চাহিদাও স্থায়ী।
ব্যবসায় জড়িত অনেকেই জানাচ্ছেন, চুল রপ্তানি করেই প্রতিবছর বাংলাদেশ আয় করছে কোটি কোটি টাকা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত চুল রপ্তানি থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে, তা এই খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।
এখন চুল শুধুই একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে একটি সামাজিক রূপান্তরের বাহক। গ্রামের বেকার যুবকরা ফেরিওয়ালা হিসেবে চুল সংগ্রহের কাজে যুক্ত হয়ে আয় করছেন, অনেকেই মহাজন হয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন। এই শিল্পে নারীরাও পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন—চুলের বিনিময়ে পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা।
তবে চুল ব্যবসার এই ব্যাপকতা এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনানুষ্ঠানিক। সরকার যদি এই খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উদ্যোগ নেয়, তবে আরও বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রাজস্ব আয় সম্ভব। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে।
চুল ব্যবসার এই ব্যতিক্রমী সাফল্য আমাদের বুঝিয়ে দেয়, সৃষ্টিশীলতা এবং উদ্যোগ থাকলে যেকোনো সামান্য বিষয় থেকেও জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব। ফেলে দেওয়া চুলকে ঘিরে গড়ে ওঠা এ শিল্প এখন শুধু একটি ব্যবসা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে ভৈরব অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রতীক।
Post a Comment