কৃষিতে বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার
কর্মহীন হচ্ছে খেটে খাওয়া শ্রমিক
জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব প্রতিনিধি ॥
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিতেও বাড়ছে আধুনিক পদ্ধতির যন্ত্রের ব্যবহার। এতে করে কৃষকদের সাশ্রয়ী হচ্ছে সময় শ্রম আর অর্থ। চাষাবাদে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়তে থাকায় কৃষকরা লাভবান হলেও কর্মহীন হচ্ছেন সনাতন পদ্ধতিতে শ্রম বিক্রি করা শ্রমিকরা। এমনি তথ্যচিত্র পাওয়া যায় বোরো মৌসুমে জোয়ানশাহী হাওরে গিয়ে। ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষকরা এখন আধুনিক যন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বললেন উপজেলা কৃষি অফিসার আকলিমা বেগম।
সরেজমিনে জোয়ানশাহী হাওরে গিয়ে দেখা যায়, সময় আর অর্থ বাঁচাতে শ্রমিকরা ধান কাটছেন যা গেল বছরের তুলনায় অনেক কম। জমির বেশিরভাগ কৃষকই তাদের ধান কাটছেন হারভেষ্টার মেশিন দিয়ে। হারভেষ্টার দিয়ে প্রতি বিঘা জমির ধান কাটতে লাগছে মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট। বিঘা প্রতি খরচ নিচ্ছে ২৫ শ থেকে ৩ হাজার টাকা। মেশিনে ধান কেটে বস্তায় ভরে গাড়িতে করে একবারে গেরস্তের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে করে কৃষকদের ধান কাটা মাড়াই আর মাথায় বহন করতে হচ্ছেনা। সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমির ধান কাটতে সময় লাগতো ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিকের সারা দিন। মজুরি নিতো ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। চাষাবাদে এখন যান্ত্রিক ব্যবহারে সময় আর অর্থ দুটোতেই সাশ্রয়ী হচ্ছেন চাষীরা।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের জোয়ানশাহী হাওরে কৃষকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন বোরো ধান কাটায়। বর্ষার পানি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকায় কৃষকরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন। ফসলের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন বলে জানান কৃষকরা। অপর দিকে শ্রমিকরা বলছেন মেশিন দিয়ে ধান কাটায় আমাদের রোজী রোজগার অনেক কমে গেছে এতে করে আমাদেরকে পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক অর্থ কষ্ট পোহাতে হবে।
অধিকাংশ জমিতেই দেখা গেছে হারভেস্টার মেশিনে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ সারছেন। ধান কাটা ও মাড়াই শেষে গাড়িতে করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের বাড়িতে। ধান পেয়ে কৃষক ও কৃষাণীরা মাঠে ধান শুকাচ্ছেন, আবার কেউবা ধান সেদ্ধ করছেন। মেশিনে ধান কাটতে পেরে দুশ্চিন্তামুক্ত হয়েছেন কৃষক। মেশিন ব্যবহারে সময় যেমন কম লাগছে, তেমনি শ্রমিকের তুলনায় খরচও অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৃষকদের অভিযোগ রয়েছে, মেশিন মালিকরা সরকার ঘোষিত নির্ধারিত চার্জের চেয়ে কিছু টাকা বেশি নিচ্ছে। পর্যাপ্ত মেশিন না থাকায় এখনো অনেক কৃষক ধান কাটা ও মাড়াইয়ে শ্রমিকদের উপরই নির্ভর রয়েছেন। কৃষকদের দাবি সামনের বছরে যেন কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে হাওরে ধান কাটার মৌসুমে পর্যাপ্ত হারভেষ্টার মেশিনের ব্যবস্থা করেন।আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের প্রতি সরকার সহযোগিতার হাত বাড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।
কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, হারভেষ্টার দিয়ে ধান কাটতে পেরে অনেকটাই দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পেরেছি। শ্রমিকের তুলনায় মেশিনে খরচ অনেক কম, তাছাড়া সময় তেমন লাগেনা। বৈশাখের মাঝঅমাজি হয়ে গেছে। কখন জানি আবার ঝড় তুফান শুরু হয় তাহলে পাকা ধানগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, আমার জমির ধান কাটারও সময় হয়ে গেছে আরো আগেই। মেশিন পাচ্ছি না বলে ধান কাটতে পারছি না। আর শ্রমিকদের দিয়ে ধান কাটলে পোষায় না। রোপণ থেকে শুরু করে কর্তন পর্যন্ত অনেক টাকা খরচ হয়। তবু চাষাবাদ করছি বছরের খাবারটা অন্ত চলে যাবে। তা ছাড়া খর দিয়ে জ্বালানি আর গরুর খাবার চলে যায়।
কৃষক আব্দুল্লাহ জানান, বাপ দাদারা চাষাবাদ করে এসেছে তাই আমরাও চাষাবাদ করছি। এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় ফসল হয়েছে ভাল। দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান কেটে গোলায় ভরতে পারলে সামনের বছরটাতে স্ত্রী সন্তানের মুখে দুটো ভাত তুলে দেয়া যাবে। তবে হারভেষ্টার মেশিন পর্যাপ্ত না থাকায় আমরা দ্রুত সময়ে ধান কাটতে পারছি না।
কৃষক ফয়সল আহমেদ বলেন, ধানের বাজার দর শ্রমিকের খরচের সাথে পোষায় না। প্রতি বিঘায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। বাজার দর আছে ৮ শ থেকে ৯ শ টাকা। সে হিসেবে আমরা লোকসানেই আছি। সরকারের কাছে অনুরোধ কৃষকদের বাঁচাতে আর কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে ১২ থেকে ১৪ টাকা দরে যেন ধান ক্রয় করেন।
রংপুরের শ্রমিক পরিদুল বলেন, বোরো মৌসুমে আমরা এখানে ধান কাটতে আসি। এতে করে আমাদের আসা যাওয়া খরচই লাগে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। এ বছর এসে দেখি জমিতে অনেকগুলো মেশিন ধান কাটছে। সে জন্য আমাদের কাজ অনেক কমে গেছে।
নেত্রকোনার শ্রমিক রসিদ ও মহিদুল জানান, আমরা গত বছর ১ বিঘা জমির ধান কাটতাম ১০ হাজার টাকায়। এ বছর ৩ বিঘা জমির ধান কাটছি ১২ হাজার টাকায়। আমাদের কাজ অনেক কমে গেছে। সামনের বছরগুলোতে মনে হয় এদিকে আর আসা হবেনা।
ফরিদপুরের কৃষক নাজমুল বলেন, এ বছর বৃষ্টি না হওয়াতে মেশিনের কদর বেড়েছে তাই আমাদের কাজ নেই। আমরা শ্রম বিক্রি করেই আমাদের সংসার চালাই। মেশিন দিয়ে ধান কাটতে থাকলে সামনে বছরে মনে হয় আমাদের আর কাজই থাকবেনা।
ভৈরব উপজেলা কৃষি অফিসার আকলিমা বেগম বলেন, ভৈরবে এ বছর প্রায় ৬ হাজার ৯শ ১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৮শ ৫৭ মেট্রিক টন যার লক্ষ্য মাত্র ছাড়িয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জোয়ানশাহী হাওর সহ বিভিন্ন এলাকায় মিলিয়ে ৩৮ টি হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে। আমা করছি, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী মে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে হাওরের ধান কাটা সম্পূর্ণভাবে শেষ করতে পারবেন কৃষকরা। এ ছাড়াও অধিকাংশ ফসল উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রে ব্যবহার বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহিত করছেন কৃষি বিভাগ।
Post a Comment