বজ্রপাতের আতঙ্কে প্রাণ হাতে নিয়ে ধান কাটছেন কিশোরগঞ্জের কৃষকরা

কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা এখন পুরোদমে চলছে। বৈশাখ মাসের আগমনেই মাঠে নেমে পড়েছেন হাজারো কৃষক। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তারা ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতা তাদের কর্মযজ্ঞে ভয় ঢেলে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত বজ্রপাতের ঘটনার কারণে মাঠে কাজ করা কৃষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে প্রাণহানির আশঙ্কা। কৃষকেরা যেন প্রতিটি দিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ধান কেটে যাচ্ছেন।

গত কয়েকদিন ধরেই জেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, যা উদ্বেগজনক। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু সতর্কতা জারি করা হলেও তেমন কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। ফলে কৃষকেরা ঝুঁকি নিয়েই মাঠে থাকছেন।

বিশেষ করে সোমবার, ২৮ এপ্রিল দিনটি কিশোরগঞ্জবাসীর জন্য এক হৃদয়বিদারক অধ্যায় হয়ে ওঠে। এদিন বজ্রপাতের ঘটনায় প্রাণ হারান পাঁচজন। মৃত্যুবরণকারী এ সকল ব্যক্তিরা প্রত্যেকে কৃষি কাজ কিংবা মাছ ধরার মতো মাটি-ঘেঁষা জীবিকায় নিয়োজিত ছিলেন।

প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে। মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে খড় শুকাতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান ৬৫ বছর বয়সী ফুলেছা বেগম। এরপর সকাল ১০টার দিকে অষ্টগ্রাম উপজেলার হালালপুর হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতের শিকার হন ৩৬ বছর বয়সী ইন্দ্রজিত দাস। একই সময় কলমা হাওরে ধান কাটতে গিয়ে প্রাণ হারান ১৪ বছর বয়সী কিশোর কৃষক স্বাধীন মিয়া। তার বয়স কম হলেও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হাওরে কাজ করছিল সে।

দুপুরে আবারো বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া ইউনিয়নের দৌলতপুর হাওরে। সেখানেও ধান কাটার সময় ৩৭ বছর বয়সী আব্দুল করিম প্রাণ হারান। বিকেলবেলা মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হন আরেকজন। কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়নের চাতল বিলে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান ৪২ বছর বয়সী জেলে মো. শাহজাহান।

এইসব প্রাণহানির ঘটনায় শোকাহত স্থানীয় জনগণ ও কৃষক সমাজ। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা মূলত কৃষি ও মৎস্যনির্ভর। কিন্তু বজ্রপাত এখন সেই জীবিকার বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই এ সময়ে হাওরে কৃষি কাজের সময় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়েছে এবং তা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

স্থানীয় কৃষকদের দাবি, ধান কাটার মৌসুমে পূর্বাভাস ও সতর্কতামূলক প্রচার বাড়ানো দরকার। একইসঙ্গে হাওরে কাজ করা কৃষকদের জন্য উপযুক্ত আশ্রয়কেন্দ্র ও বিদ্যুৎসুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জোরালো হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও হাওরাঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিশেষ টিম গঠনের কথা জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের মোট বোরো ধানের একটি বড় অংশ আসে কিশোরগঞ্জসহ হাওরজেলার ফসলি জমি থেকে। সময়মতো ধান না কাটলে পুরো বছরের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। ফলে কৃষকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মাঠ ছাড়তে পারছেন না।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বজ্রপাত প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার, ফিল্ডে কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে সচেতনতা বাড়ানো সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post