কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলায় এক যুবক অনলাইন জুয়ার নেশা থেকে মুক্তির শপথ নিয়ে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দীর্ঘদিন আসক্তির কারণে জীবনের সবকিছু হারিয়ে এখন নতুন করে শুরু করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কটিয়াদি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছয় লিটার দুধ দিয়ে গোসল করে তিনি ঘোষণা দেন, আর কখনো জুয়ার ফাঁদে পা দেবেন না।
স্থানীয়ভাবে আলোচিত এই যুবকের নাম আল-আমিন (৩০)। তিনি উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের অষ্টগড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশায় পিকআপ চালক। একসময় তিনি দুটি টমটম ও দুটি পিকআপের মালিক ছিলেন। পরিশ্রম আর উদ্যোগ দিয়ে সংসারও ভালোই চলছিল। কিন্তু প্রযুক্তির যুগে সহজলভ্য অনলাইন জুয়া তাকে ধীরে ধীরে টেনে নেয় অন্ধকার গহ্বরে।
গত এক বছরে শুধু অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে তিনি প্রায় আট লাখ টাকা হারান। জুয়ার টাকা মেটাতে বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হয়েছে তার একটি টমটম ও একটি পিকআপ। ফলে সংসারেও নেমে আসে অস্থিরতা। একসময় চারপাশের মানুষদের চোখে সফল পরিশ্রমী হিসেবে পরিচিত হলেও, জুয়ার কারণে আজ তাকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়েছে ভাঙা জীবনের সামনে।
আল-আমিনের চাচা এখলাস মিয়া জানান, ভাগ্নে আগে অনেক পরিশ্রমী ছিল। নিজের চেষ্টায় কয়েকটি গাড়ি কিনে সংসারকে সচ্ছলতা দিয়েছিল। কিন্তু অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে সবকিছু শেষ করে ফেলে। এখন পরিবারের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর কখনো জুয়ার দিকে ফিরবে না। সেই শপথের অংশ হিসেবেই জনসম্মুখে দুধ দিয়ে গোসল করেছে।
এদিন স্থানীয়দের সামনে দাঁড়িয়ে আল-আমিন নিজেও আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “জুয়া খেলে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। গত এক বছরে প্রায় আট লাখ টাকা হারিয়েছি। এমনকি দুইটা গাড়িও বিক্রি করতে হয়েছে। আমি সবার কাছে দোয়া চাই, যেন জীবনের বাকি সময়ে আর কোনোদিন এই আসক্তির পথে না যাই।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গোসলের ভিডিও ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এটিকে অদ্ভুত এবং নাটকীয় মনে করলেও, কেউ কেউ এটিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে দৃঢ় সংকল্প দরকার, আর আল-আমিনের শপথ হয়তো অনেক যুবককে অনলাইন জুয়ার ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করবে।
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সহজ অর্থের প্রলোভনে এই অবৈধ খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন। অথচ এই জুয়ার পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সঞ্চয়, সংসার এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালালেও নতুন নতুন অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জুয়ার বাজার দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইন জুয়া কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি ধীরে ধীরে মানুষকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। হতাশা, উদ্বেগ, পারিবারিক কলহ এবং আত্মবিশ্বাস হারানো—সবকিছুই এর পরিণতি। তাই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই আসক্তি থেকে তরুণদের রক্ষা করা কঠিন হবে।
আল-আমিনের ঘটনা হয়তো একটি ব্যতিক্রমী সংবাদ। তবে এর ভেতর দিয়ে অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা এবং তা থেকে মুক্তির জন্য তরুণদের আকুতি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তার শপথ যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে সেটি কেবল একটি ব্যক্তিগত জয়ের গল্প হবে না—বরং অন্যদের জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
Post a Comment