জয়নাল আবেদীন রিটন, ভৈরব থেকে:
প্রাচীনকাল থেকে ভৈরবসহ গ্রামগঞ্জ ও শহরের মানুষের কাছে আখের গুড় একটি প্রিয় খাদ্য হিসেবে পরিচিত। রসনা বিলাসী বাঙালির পছন্দের ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখন বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর মুনাফার উৎসে পরিণত হয়েছে। অতি লাভের লোভে তারা আখের পরিবর্তে চিনির গুড় তৈরি করছেন, যেখানে ব্যবহার হচ্ছে চিনি, চুনের পানি, হাইড্রোজ, ফিটকিরি প্রভৃতি ক্ষতিকারক উপকরণ। এসব ভেজাল গুড় শুধু ভৈরবে নয়, আশপাশের জেলা ও উপজেলা বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।
কারখানা মালিক শিমুল পোদ্দার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গুড় উৎপাদনের জন্য বিএসটিআই বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় না, যা অনেকেই শোষণ করছেন।
গত কয়েক বছর ধরে ভৈরবের বেশ কয়েকটি কারখানায় চিনি, ফিটকিরি, চুনের পানি ও হাইড্রোজ মিশিয়ে গুড় তৈরি করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্ট কয়েকবার অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করেছে, কিন্তু কিছুদিন বন্ধ থাকার পর আবারও ভেজাল গুড় উৎপাদন শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ভৈরবের প্রতিটি আড়তে এই চাপাই গুড় ছড়িয়ে পড়েছে এবং রাজশাহীর বিভিন্ন স্থান থেকেও অবাধে এসব গুড় আনা হচ্ছে। প্রশাসনের নিরবতা ও উদাসীনতার কারণে এ অবস্থা ক্রমেই বেড়েই চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভৈরব বাজারের কারখানাগুলোতে যেখানে আখের আঁটি থাকার কথা, সেখানে সাজানো রয়েছে চিনির বস্তা। কারিগররা গরম পাত্রে কয়েক বস্তা চিনি ঢেলে, পানি ও ক্ষতিকারক উপকরণ মিশিয়ে আধা ঘণ্টা নাড়াচাড়া করে গুড়ের মতো তরল তৈরি করেন। এরপর তা বিভিন্ন পাত্রে ঢেলে প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয় ও আশপাশের বাজারে বিক্রি করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী দাবি করেন, শিমুল পোদ্দার স্থানীয় আওয়ামী লীগের উচ্চপদস্থ ব্যক্তির ছেলে বলে ব্যবসায় সুবিধা পাচ্ছেন এবং বর্তমানে বিএনপির দিকে ঝুঁকছেন।
“মিশুক ট্রেডারর্স” নামে একটি কারখানায় কয়েক বছর ধরে এসব ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছে, শিমুল পোদ্দার পরিচালনায়। মোবাইল কোর্টে ধরা পড়ার পরও কিছুদিন কারখানা বন্ধ থাকলেও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আবার কাজ শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এক ব্যবসায়ী বলেন, “কয়েক মাস আগে প্রশাসন অভিযান চালিয়েছিল, তারপরও গুড় উৎপাদন থেমে যায়নি। মাঝে মধ্যে দিনে-রাতে গুড় তৈরি হচ্ছে।”
গুড় তৈরির কারিগররা জানাচ্ছেন, তারা গরম পাত্রে ২০ লিটার পানিতে এক বস্তা চিনি দিয়ে ফিটকিরি, হাইড্রোজ ও চুনের পানি মিশিয়ে আধা ঘণ্টা গরম রাখেন। তরল পদার্থ আঠালো হয়ে গুড়ের রূপ নেয় এবং তা পাত্রে ঢেলে শক্ত হতে দেন। এরপর প্যাকেট করে বাজারে বিক্রি করা হয়।
খুচরা বিক্রেতা আলমগির মিয়া জানান, তার কারখানার থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ প্যাকেট এই ভেজাল গুড় ভৈরবসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়।
ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক কিশোর কুমার ধর বলেন, “চিনি, ফিটকিরি, চুন ও হাইড্রোজ মিশিয়ে তৈরি এই গুড় স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এটি স্নায়ুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। বয়স্কদের কিডনি ও লিভারেও সমস্যা বাড়ায়। তাই প্রশাসনের উচিত দ্রুত নজরদারি করে এই ভেজাল গুড়ের উৎপাদন বন্ধ করা।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শবনম শারমিন বলেন, “অস্বাস্থ্যকর উপকরণ দিয়ে গুড় তৈরি কারখানার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ আবার ভেজাল গুড় উৎপাদন শুরু করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
Post a Comment