৪৫ বছর ভাত ছাড়াই সুস্থ জীবন: কিশোরগঞ্জের বিপ্লবের অদ্ভুত গল্প

৪৫ বছর ভাত ছাড়াই সুস্থ জীবন: কিশোরগঞ্জের বিপ্লবের অদ্ভুত গল্প
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার নগর গ্রামে বাস করেন বিপ্লব নামের এক মধ্যবয়সী মানুষ, যিনি গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাত স্পর্শ করেননি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশি জীবনের সঙ্গে ভাতের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, সেখানে বিপ্লবের এই ব্যতিক্রমী জীবনধারা তাকে স্থানীয়ভাবে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।

বিপ্লবের বয়স এখন ৫০। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই তিনি ভাত খেতে অস্বস্তি বোধ করতেন। প্রথমদিকে পরিবারের লোকজন বিষয়টিকে খামখেয়ালিপনা বা শিশুসুলভ অনীহা বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি অন্যরকম রূপ নেয়। ভাত মুখে দিলেই তার শরীরে অসহ্য অস্বস্তি ও বমি শুরু হতো। বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় চিকিৎসক ও কবিরাজদের শরণাপন্ন হলেও কোনো কার্যকর সমাধান মিলেনি। অবশেষে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তাকে আর ভাত খেতে বাধ্য করা হবে না।

এরপর থেকে বিপ্লব রুটি, ডাল, শাকসবজি, মাছ-মাংস এবং ফলমূলের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন শুরু করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভাতের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি আজও সুস্থ, সবল এবং স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছেন।


---

ভাত ছাড়া টিকে থাকার বিস্ময়

বাংলাদেশে ভাত শুধু প্রধান খাদ্য নয়, বরং সংস্কৃতি ও জীবনধারার অংশ। সকালে, দুপুরে কিংবা রাতে— দিনের প্রতিটি আহারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ভাত। এমন প্রেক্ষাপটে বিপ্লবের ৪৫ বছর ভাত ছাড়া কাটিয়ে দেওয়া বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সবার কৌতূহল জাগিয়েছে।

বিপ্লবের বড় ভাই স্বপন মিয়া জানান,

> “আমরা ভাত ছাড়া একদিনও চলতে পারি না। অথচ আমার ভাই বিপ্লব প্রায় আধা জীবন ভাত মুখে দেয়নি। অবাক করা বিষয় হলো, সে একেবারেই সুস্থ আছে।”



প্রতিবেশীরাও বিষয়টিকে বিস্ময়ের চোখে দেখেন। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন,

> “উৎসব কিংবা দাওয়াতে আমরা সবাই ভাত খাই, কিন্তু বিপ্লব কখনো ভাতের পাতে হাত দেয় না। অন্য খাবার খেলেই তার চলে যায়।”




---

চিকিৎসকের দৃষ্টিতে ব্যতিক্রমী ঘটনা

স্থানীয় চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অস্বাভাবিক হলেও সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। তারা মনে করেন, বিপ্লব সম্ভবত কোনো বিশেষ ধরনের খাদ্য-অসহিষ্ণুতা (Food Intolerance) সমস্যায় ভুগছেন। সাধারণত চাল বা ভাত মানবদেহে শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কিছু মানুষ জেনেটিক বা শারীরিক কারণে এটি হজম করতে পারেন না।

চিকিৎসক ডা. মাহফুজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন,

> “মানবদেহের জন্য চালজাত খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিরল ক্ষেত্রে কেউ কেউ তা সহ্য করতে পারে না। তবে ৪৫ বছর ধরে ভাত ছাড়াই সুস্থ থাকা সত্যিই ব্যতিক্রমী। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হলে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।”




---

‘ভাত ছাড়া মানুষ’ নামে পরিচিত

নিকলীর নগর গ্রামে এখন বিপ্লবকে সবাই ‘ভাত ছাড়া মানুষ’ বলে ডাকেন। গ্রামের বাইরে থেকেও অনেক মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, নিজের চোখে ঘটনাটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য। কেউ কেউ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে ভাত ছাড়া এত বছর পার করলেন? বিপ্লব সাধারণভাবে উত্তর দেন, “ভাত খেলেই আমার শরীর খারাপ হয়, তাই রুটি ও অন্যান্য খাবার খেয়েই জীবন কাটাচ্ছি।”


---

ব্যতিক্রমী এক জীবনধারা

বিপ্লবের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় প্রধানত থাকে গমের রুটি, বিভিন্ন শাকসবজি, মাছ, মাংস ও ফলমূল। তিনি নিয়মিত কাজকর্ম করেন, মাঠে-ঘাটে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেন এবং স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও কোনো বড় সমস্যা নেই।

চিকিৎসকরা বলছেন, ভাত না খেলেও তিনি যেহেতু প্রয়োজনীয় পুষ্টি অন্যান্য উৎস থেকে পাচ্ছেন, তাই শরীরে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়নি। তবে এ ধরনের মানুষ অত্যন্ত বিরল।


---

বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপ্লবের মতো ঘটনা চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ একটি ভাতনির্ভর দেশ হওয়ায় এখানে চালের প্রতি মানুষের নির্ভরতা অত্যধিক। এর মাঝে একজন মানুষ এত বছর ভাত না খেয়েও সুস্থ জীবন যাপন করছেন— এটি নিঃসন্দেহে চিকিৎসা ও পুষ্টিবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post