সংসার রক্ষার জন্য, পাগলা মসজিদের দানবাক্সে চিঠি

সংসার রক্ষার আর্তি, পাগলা মসজিদের দানবাক্সে হৃদয় ছোঁয়া চিঠিস্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ শুধু ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার প্রতীক নয়, এটি অসংখ্য মানুষের আশা, দুঃখ-বেদনা ও আকাঙ্ক্ষার অশ্রুসিক্ত ঠিকানা হয়ে উঠেছে। শনিবার সকালে মসজিদের ১৩টি দানবাক্স খোলার পর পাওয়া এক নারীর হৃদয়স্পর্শী চিঠি তা আবারও প্রমাণ করল।সকাল ৭টায় দানবাক্সগুলো খোলার কাজ শুরু হয়। প্রতিবারের মতো এবারও দেখা গেলো টাকার স্তুপ, স্বর্ণালঙ্কার ও বিদেশি মুদ্রার পাশাপাশি শত শত আবেদনমাখা চিরকুট। এসব চিঠির প্রতিটি যেন মানুষের জীবনের একেকটি গল্প। এর মধ্যে একটি চিঠি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে—যেখানে সংসার রক্ষার জন্য এক নারীর কান্নাভেজা আর্তি ফুটে উঠেছে।চিঠিতে ওই নারী লিখেছেন, তিনি বারো বছর আগে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, তাহাজ্জুদ ও রোজা পালন করছেন। কিন্তু সব চেষ্টার পরও দুইবার গর্ভের সন্তান হারানোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানে তিনি আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাই চিঠিতে তিনি লিখেছেন—“আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারি। যদি আল্লাহ আমার এই আশা পূর্ণ করেন, তবে আমি সন্তানকে নিয়ে এই মসজিদে একটি সোনার চাঁদ দান করব। কিন্তু যদি তা না হয়, তবে আমাকে সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে।”শুধু তাই নয়, তিনি আরও লিখেছেন, “আমার পাশে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। আমি অসহায়, সবাই দোয়া করবেন।”আবেগঘন চিঠির ঝাঁপিপ্রতিবার দানবাক্স খোলার সময় এমন শত শত চিঠি হাতে আসে। কখনও কেউ পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আকুতি জানায়, কেউ চাকরির আশায় লিখে, আবার কেউ প্রিয় মানুষকে ফিরে পাওয়ার বা রোগমুক্তির আবেদন জানায়। এই দানবাক্স যেন হয়ে উঠেছে অগণিত মানুষের আশা-প্রার্থনার প্রতিফলন।মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, কেবল টাকা-পয়সাই নয়, এসব চিঠি অনেক সময় মানুষের অন্তর্দহন ও আস্থার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। তাই এগুলোকে সংরক্ষণ করা হয় বিশেষ যত্নে।কোটি টাকার দানএবার ৪ মাস ১৮ দিন পর দানবাক্স খোলা হলো। গণনার প্রথম দিনেই জমা পড়েছে ৩২ বস্তা টাকা। পাশাপাশি মিলেছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, রুপা ও বিদেশি মুদ্রা। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে কাজ করছেন ৩৪০ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী, ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৩৩ জন শিক্ষক-স্টাফ, ৯ জন সেনা সদস্য, ৩০ জন পুলিশ সদস্য, পাঁচজন আনসার ব্যাটালিয়ন এবং আরও ১০ জন আনসার সদস্য। এ ছাড়া ১০০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী এই কাজে অংশ নিচ্ছেন।প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যেই দানকৃত অর্থের অঙ্ক দাঁড়ায় সাড়ে ৮ কোটি টাকারও বেশি।ভক্ত-আস্থার প্রতীকস্থানীয়রা বলছেন, পাগলা মসজিদ শুধু ইবাদতের জায়গা নয়, মানুষের বিশ্বাস-ভালোবাসা ও জীবনের গল্পেরও কেন্দ্রবিন্দু। দানবাক্সে জমা পড়া কোটি কোটি টাকা যেমন আস্থার প্রমাণ, তেমনি অসংখ্য অশ্রুভেজা চিঠিও মানুষের মনের ব্যথা ও স্বপ্নকে প্রকাশ করে।মসজিদ পরিচালনা কমিটির এক সদস্য জানান, দানবাক্সের প্রতিটি টাকা ও দানকৃত সম্পদ সঠিকভাবে হিসাব করা হয় এবং তা ধর্মীয়, সামাজিক ও দাতব্য কাজে ব্যয় করা হয়। তবে চিঠিগুলোর আবেগ অন্যরকম। এগুলো পড়ে বোঝা যায়, মানুষ কতটা আস্থার সঙ্গে তাদের কষ্ট, দুঃখ, আকুতি ও আশা আল্লাহর কাছে তুলে ধরছে।জীবনের প্রতিচ্ছবিমানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ানো এসব চিঠি দেখায়, ধর্মীয় স্থানের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা কতটা গভীর। কোনো তরুণ লিখছে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য, কোনো গৃহবধূ লিখছে সংসার টেকানোর আর্তি, আবার কেউ অসুস্থ সন্তানের সুস্থতার প্রার্থনা করছে।অন্যদিকে দানবাক্সে স্বর্ণালঙ্কার, টাকাপয়সা ও বিদেশি মুদ্রা জমা দেওয়া প্রমাণ করে, মানুষ তাদের কষ্টার্জিত সম্পদও আল্লাহর রাস্তায় দান করতে পিছপা হয় না।এক টুকরো আশাপাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই শুধু অর্থ নয়, উঁকি দেয় মানুষের আশা, বেদনা ও জীবনের গল্প। এবারও সেই ধারাবাহিকতায় এক নারীর হৃদয়স্পর্শী চিঠি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। হয়তো এই চিঠি কেবল তাঁর সংসার রক্ষার প্রার্থনাই নয়, বরং মানবজীবনের অনিশ্চয়তা ও আশার প্রতীক হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।

Post a Comment

Previous Post Next Post