পাকুন্দিয়ায় ঈদগাহ মাঠ কমিটি বাতিলের জেরে এসিল্যান্ডসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, কিশোরগঞ্জ
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় সদর ঈদগাহ মাঠ পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের জেরে কমিটি স্থগিত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় জড়িত উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও পাকুন্দিয়া পৌর প্রশাসকসহ মোট ২৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন পূর্বের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান এবং সেক্রেটারি সিদ্দিক হোসেন মাসুদ গত ৩ জুলাই কিশোরগঞ্জের সহকারী জজ আদালতে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২১ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য বিবাদীদের নোটিশ প্রদান করেছে।

মামলায় প্রধান বিবাদী করা হয়েছে পাকুন্দিয়া পৌর প্রশাসক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মামুন সরকারকে। এছাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, পাকুন্দিয়া থানার ওসি, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ ২৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী পাকুন্দিয়া সদর ঈদগাহ মাঠের ইতিহাস প্রায় একশ বছর আগে থেকে। ১৯২২ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহের গভর্নর খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেন এই মাঠের জন্য জমি দান করেন। ঈদগাহের আওতায় বর্তমানে দুটি বহুতল ভবন, ৪১টি দোকান ও একটি পুকুরসহ প্রায় দুই একর সম্পত্তি রয়েছে, যা থেকে মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা ভাড়া আদায় হয়। এই ঈদগাহ মাঠের ফান্ড বর্তমানে কোটি টাকারও বেশি বলে জানা গেছে।

প্রায় দুই দশক ধরে এই ঈদগাহ মাঠ একটি নির্বাচিত ৩১ সদস্যের কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছিল, যার মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা ছিল। তবে সম্প্রতি স্থানীয় মুসুল্লিদের একাংশ অভিযোগ তোলেন, কমিটি দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এক দাতা সদস্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে প্রশাসন ঈদগাহ পরিচালনার দায়িত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করে ২৬ জনের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে।

এ বিষয়ে সাবেক কমিটির নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, চলমান কমিটির মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে এডহক কমিটি গঠন করেছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। মামলার বাদী সেক্রেটারি সিদ্দিক হোসেন বলেন, “আমাদের কমিটি ইলেক্টরাল কলেজের মাধ্যমে বৈধভাবে নির্বাচিত। হঠাৎ করে এই কমিটি স্থগিত করার অধিকার প্রশাসনের নেই।”

সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমানের বক্তব্য, “ঈদগাহের মালিক হচ্ছে সাধারণ মুসল্লিরা। এটির দেখভাল জনগণেরই দায়িত্ব। প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে পারে না।”

অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদগাহের ভেতরে অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগ থাকায় এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। পাকুন্দিয়া পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মামুন সরকার বলেন, “ঈদগাহের পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এসেছে। নিয়মিত হিসাব দাখিলের নোটিশ দিয়েও কোনো সহযোগিতা পাইনি। তাই তদন্তের স্বার্থে নতুন কমিটি গঠন করেছি।”

পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, “ঈদগাহ মাঠের আর্থিক অনিয়ম এবং শৃঙ্খলার অবনতির শঙ্কা থাকায় সাময়িক কমিটি করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাবেক কমিটি তদন্তে সহযোগিতা না করে আদালতে গিয়েছে, এতে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাই স্পষ্ট হয়।”

অন্যদিকে বর্তমান এডহক কমিটির কয়েকজন সদস্য দাবি করেছেন, তাদের অনেকেরই এই কমিটিতে মনোনীত হওয়ার বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মানুষের ফোনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের খবর জেনেছেন। একজন সদস্যের ভাষায়, “আমাদের মতামত ছাড়াই নাম রাখা হয়েছে। এখন মামলা পড়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েছি।”

এ ঘটনায় স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হয়েছে। কেউ বলছেন, প্রশাসনের হস্তক্ষেপেই ঈদগাহের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে কেউ মনে করছেন, জনগণের কমিটি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি চাপিয়ে দেওয়া অনৈতিক।

প্রশাসন ও আগের কমিটির মধ্যে এই টানাপোড়েনের ফলে ঈদগাহ মাঠের ভবিষ্যৎ পরিচালনা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আদালতের নির্দেশনা মেনে বিবাদীরা কারণ দর্শানোর জবাব দেবেন কি না এবং শেষ পর্যন্ত কোন কমিটি মাঠের দায়িত্বে থাকবে, তা এখন সময়ের ব্যাপার।

#কিশোরগঞ্জসংবাদ #Kishoreganjsongbad #পাকুন্দিয়াসংবাদ #ঈদগাহমাঠবিতর্ক #পাকুন্দিয়ামামলা #কিশোরগঞ্জজেলা

Post a Comment

Previous Post Next Post