বিশেষ সাক্ষাৎকারবিষয়: কিশোরগঞ্জ সদরে তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরসাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: বিশেষ প্রতিবেদক, কিশোরগঞ্জ সংবাদসাক্ষাৎকারদাতা: মাও. আতাউর রহমান নীলগঞ্জী, তরুণ রাজনীতিবিদ, সমাজবিশ্লেষক ও শিক্ষানুরাগী

📰 বিশেষ সাক্ষাৎকার
বিষয়: কিশোরগঞ্জ সদরে তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: বিশেষ প্রতিবেদক, কিশোরগঞ্জ সংবাদ
সাক্ষাৎকারদাতা: মাও. আতাউর রহমান নীলগঞ্জী, তরুণ রাজনীতিবিদ, সমাজবিশ্লেষক ও শিক্ষানুরাগী


কিশোরগঞ্জ সদর থানার অলিগলি ঘুরলেই বোঝা যায়—এলাকার তরুণদের মাঝে রাজনীতির একটি নতুন জাগরণ শুরু হয়েছে। আর এই জাগরণ আর যেই পুরনো রাজনৈতিক বৃত্তে আটকে নেই, বরং দিন দিন তরুণ সমাজ এক বিকল্প ও মূলভিত্তিক নেতৃত্বের খোঁজে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিসরে এক সময় যেসব নাম উচ্চারিত হতো—বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির মতো দল—তরুণদের মধ্যে সেই আগ্রহ আজ আর আগের মতো নেই।

গত এক মাসে সদর থানার অন্তত পাঁচটি ইউনিয়নের উপর মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ, কয়েকটি কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা, এবং স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতামত গ্রহণ করে এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন—তরুণরা এখন আর স্রেফ দলীয় ব্যানারে মোহিত নয়। তারা নেতৃত্বে চায় সত্য, নৈতিকতা, এবং আদর্শ।

তরুণদের রাজনীতি নিয়ে উদীয়মান  নতুন ভাবনার আদ্যপ্রান্ত জানতে কিশোরগঞ্জ সংবাদ কথা বলেছে তরুণ রাজনীতিবিদ মাও. আতাউর রহমান নীলগঞ্জী'র সাথে। ট্রেডিশনাল নেতৃত্ব থেকে বের হয়ে তরুণরা কেন নতুন নেতৃত্ব চাচ্ছে তার বিচার বিশ্লেষণ করেছেন কিশোরগঞ্জ সংবাদ এর বিশেষ সাক্ষাৎকারে। 

কিশোরগঞ্জ সংবাদ : আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন। 
মাও:  আতাউর রহমান : ওয়ালাইকুম আসসালাম।  আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।  আপনি কেমন আছেন? 
কিশোরগঞ্জ সংবাদ : আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। 
---

প্রশ্ন: আতাউর সাহেব, আপনার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে এমন অনেকেই বলেন, সদর থানার তরুণরা দিন দিন প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আপনি এই প্রবণতাকে কীভাবে দেখছেন?

আতাউর রহমান: ধন্যবাদ। এটা নিছক অনুভূতির বিষয় নয়—এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বললে, আমরা একটি "অভার-পারসোনালাইজড পলিটিক্যাল সিস্টেম"-এর মধ্যে দীর্ঘদিন আটকে ছিলাম, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক, উত্তরাধিকারনির্ভর ও দলানুরক্ত ছিল। এতে তরুণদের জন্য অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র (Participatory Democracy) যেমন দূরবর্তী হয়ে উঠেছে, তেমনি রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যকার আস্থার সম্পর্কও দুর্বল হয়েছে।


---

কিশোরগঞ্জ সংবাদ: আপনি বলছেন তরুণরা নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়ে গেছে? তারা তো বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনে যুক্ত হয়?

আতাউর রহমান: হ্যাঁ, যুক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু সেখানে তারা কতটা ‘লিডার’ আর কতটা ‘ল্যাডার’—এই প্রশ্নটা জরুরি। বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনই এখন Clientelism Model-এর অধীনে চলে, যেখানে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ নেই, বরং উপরের নেতার অনুগত্যই মূল পুঁজি। তরুণেরা এখন বুঝতে শিখেছে—এটা নেতৃত্ব নয়, এটা চুক্তিভিত্তিক ব্যবহার। ফলে তারা বিকল্প খুঁজছে—যেখানে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ও আত্মমর্যাদাবোধ থাকবে।


---

কিশোরগঞ্জ সংবাদ: তাহলে কী সেই বিকল্পে ইসলামী নেতৃত্ব উঠে আসছে?

আতাউর রহমান: এটা অনিবার্য এক ট্রানজিশন। যখন রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামো "Ethical Vacuum" তৈরি করে, তখন জনগণ ‘নীতি-ভিত্তিক নেতৃত্ব’ খোঁজে। বাংলাদেশের সমাজতাত্ত্বিক বাস্তবতায় এই শূন্যস্থান পূরণ করছে ইসলামী মূল্যবোধে গঠিত নেতৃত্ব। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আস্থার বিষয় নয়—বরং এটা Value-Oriented Political Preference।

তরুণরা এখন জানে—ইসলামী ঘরানার নেতৃত্ব মানেই শুধু মিম্বর নয়, বরং character-driven, accountability-based নেতৃত্ব, যেখানে দায়িত্ব মানে আমানত, আর জনপ্রিয়তা নয়।


---

কিশোরগঞ্জ সংবাদ: আপনি বলছেন তরুণরা ইসলামী নেতৃত্বে আস্থা রাখছে কারণ তা নৈতিক? কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ?

আতাউর রহমান: একেবারেই না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, তরুণদের এই ঝোঁক মূলত Political Legitimacy Crisis-এর প্রতিক্রিয়া। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, নেতৃত্বের তিনটি বৈধতা থাকে—Traditional, Charismatic ও Rational-Legal। আমরা দেখছি, ট্র্যাডিশনাল পার্টিগুলোর নেতৃত্ব আর তরুণদের চোখে বৈধতা হারিয়েছে। তারা যেখানে চেনা নামে ভরসা পায় না, সেখানে পরিচ্ছন্ন, আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্বে তারা “Legitimacy of Morality” খুঁজে পাচ্ছে।


---

কিশোরগঞ্জ সংবাদ: আপনি কিশোরগঞ্জ সদর থানার কথা বলছিলেন। এখানে কী বাস্তব প্রমাণ আছে যে তরুণরা এখন অন্য রকম নেতৃত্ব খোঁজে?

আতাউর রহমান: অবশ্যই। আমি নিজে সদর উপজেলার অন্তত ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। তারা সরাসরি বলেছে—পুরনো রাজনীতি আমাদের কথা ভাবে না। তারা বলে—আমরা কেন সেইসব নেতাদের অনুসরণ করবো, যারা নিজেরাই স্বার্থে বিভোর?

তারা যে নেতৃত্ব চায়, তাতে থাকতে হবে—Value Congruence (নৈতিক মূল্যবোধের মিল), Communal Empathy (জনমানুষের কষ্ট বোঝার ক্ষমতা) এবং Service-Oriented Mindset। আমি দেখেছি, অনেক ছাত্র এখন রাজনৈতিক পরিচয়ের চাইতে আদর্শিক পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেয়।


---

কিশোরগঞ্জ সংবাদ: আপনি নিজেও তরুণ রাজনীতিবিদ হিসেবে কাজ করছেন। আপনি কী দেখছেন ভবিষ্যতের জন্য?

আতাউর রহমান: আমি মনে করি আমরা এখন একটি Political Realignment Phase-এর মধ্যে আছি। এটি ‘পার্টি চেঞ্জ’ নয়, ‘পার্সপেকটিভ চেঞ্জ’। ভবিষ্যতের রাজনীতি হবে Issue-Based & Ethics-Centric। তরুণরা এখন নেতৃত্ব মানে শুধু পদের অধিকার নয়, দায়বদ্ধতা এবং আস্থা তৈরি করার ক্ষমতা হিসেবে দেখছে।

তারা যাদের অনুসরণ করছে, তারা জনপ্রিয় বক্তা নয়—বরং নীরবে কাজ করা, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা মানুষ। এটাই আগামী দিনের রাজনীতির মুখ।

Post a Comment

Previous Post Next Post