বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চল দিনকে দিন বজ্রপাতের মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ জলাভূমি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রাণহানি বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বিশেষত ধান কাটার মৌসুমে কৃষকেরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামছেন।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসেই (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) দেশে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৭ জন। এই হার শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, বাস্তবতার দিক থেকেও ভয়ংকর, বিশেষত হাওড় অঞ্চলের কৃষকদের জন্য।
বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি, কিন্তু প্রয়োগ নেই বাস্তবে
২০১৫ সালে সরকার বজ্রপাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিলেও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা বা প্রতিরোধমূলক কর্মসূচির উন্নয়ন একেবারেই নেই বললেই চলে। হাওড়ের কৃষকেরা বলেন, “প্রতি বছর আমরা ধান কাটার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামি। বজ্রপাতের আশঙ্কায় চোখের সামনে আকাশ কালো হলে কাজ ফেলে পালানোর মতো অবস্থা হয়।”
আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে যখন কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি থাকে, তখনই মূলত ধান কাটার মৌসুম। কৃষকেরা খোলা আকাশের নিচে থাকা অবস্থায় হঠাৎ বজ্রপাতে আহত বা নিহত হন।
প্রযুক্তিনির্ভর আগাম সতর্কতা থাকলেও বাস্তব সুবিধা সীমিত
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোহাম্মাদ কাজী মজিবুর রহমান জানান, “আমরা একটি আবহাওয়া তথ্যভিত্তিক গ্রুপ তৈরি করেছি। এখানে প্রতি মুহূর্তের আবহাওয়ার আপডেট দেয়া হয়। পাশাপাশি একটি অনলাইন পোর্টালেও নিয়মিত বুলেটিন এবং জরুরি পূর্বাভাস দেয়া হয়।”
তবে প্রশ্ন হলো, হাওড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব প্রযুক্তিভিত্তিক বার্তা আদৌ কৃষকের হাতে পৌঁছায় কি না? বিশেষ করে যাঁরা এখনো স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট থেকে দূরে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা জরুরি
আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেন, “এপ্রিল-মে মাসে কালবৈশাখীর প্রকোপ বেশি থাকে। এই সময় ধান কাটার শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাদের জন্য হাওড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে বজ্রপাত প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি।”
অন্যদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. ইফতি খায়রুল আমিন জানান, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাতাসে আয়ন কণার পরিমাণ বেড়েছে, যা বজ্রপাত বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বজ্রপাত যেহেতু উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহ, তাই নির্দিষ্ট পাথ বা প্রযুক্তিগত কন্ডাক্টর বসিয়ে তা নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নেয়া সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “সঠিকভাবে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মানুষ এবং স্থাপনাকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।”
জনসচেতনতা ও স্থানীয় উদ্যোগের অভাব
বজ্রপাতের সময় কী করণীয়, কোথায় আশ্রয় নিতে হবে, কোন পরিস্থিতিতে বেশি ঝুঁকি থাকে – এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কৃষকেরা পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। এজন্য স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
সমাধানের পথ: সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি
হাওড় অঞ্চলে বজ্রপাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে শুধু সচেতনতা নয়, প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বাস্তব ব্যবহার। প্রতিটি বড় হাওড় অঞ্চলে বজ্রনিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র, ফিল্ড পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, এবং মোবাইল ভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থার সার্বিক সম্প্রসারণ করতে হবে।
সরকারের নীতিনির্ধারক ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিত, বাজেট পরিকল্পনায় বজ্রপাত প্রতিরোধক প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা এবং বাস্তবায়নে যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা।
Post a Comment