‘নতুন বাংলাদেশেও’ কেন ইসলামপন্থীরা বারবার বৈষম্যের শিকার?

নিউজ ডেস্ক | ১২ মে ২০২৫

‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের পেছনে যারা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন, সেই ইসলামপন্থীরাই এখনো নানা প্রকার বৈষম্যের মুখোমুখি—এমন অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র ও জনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই নতুন পথচলার মূল লক্ষ্যই ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সাম্যতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়া। অথচ ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও ধর্মীয় ও আদর্শিকভাবে ইসলামী চিন্তাধারার রাজনীতিক ও নাগরিকরা এখনো কাঙ্ক্ষিত সম্মান ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছেন না।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘নাগরিক কোয়ালিশন’ নামের একটি নতুন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার উদ্যোগের আয়োজন নিয়ে এই বৈষম্য আবারো প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গতকাল রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও সেখানে কোনো ইসলামপন্থী সংগঠন, আলেম সমাজ কিংবা ধর্মীয় চিন্তাবিদদের স্থান দেওয়া হয়নি। এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এটিকে ‘ইচ্ছাকৃত বাদ দেওয়া’ বলে উল্লেখ করছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় চিন্তাধারাভিত্তিক রাজনীতি প্রায় সব সময়েই প্রান্তিক অবস্থানে থেকেছে। শিক্ষা, প্রশাসন কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলেম-উলামা ও মাদরাসা-শিক্ষিত ব্যক্তিদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়নি। অথচ দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী আজও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধারণ করে জীবন পরিচালনা করে আসছেন। তাই এই শ্রেণির অংশগ্রহণকে অগ্রাহ্য করা মানে জনগণের একটি বড় অংশকে প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করা।

বিশ্লেষকদের মতে, নতুন বাংলাদেশ গঠনের সময় ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা গোষ্ঠীগুলো বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা রাজপথে ছিলেন, প্রতিবাদ করেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সেই সাহসী ভূমিকার জন্য তাদের কৃতিত্ব স্বীকার করা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ছিল সময়ের দাবি। অথচ এখনো তারা রাজনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াগুলোতে অবহেলিতই রয়ে গেছেন।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিমাতাসুলভ আচরণকে নতুন প্রজন্মের ইসলামপন্থীরা আর মেনে নিতে নারাজ। তাদের দাবি, যে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কোনো গোষ্ঠীকে আদর্শের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া সাম্যের পরিপন্থী। ইসলামি দল বা আলেমদের বাদ দিয়ে গঠিত যেকোনো সংলাপ বা জোট প্রকৃতপক্ষে অসম্পূর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলেও তারা অভিযোগ করছেন।

তবে শুধু অভিযোগ করেই থেমে থাকতে রাজি নন তারা। নতুন প্রজন্মের ইসলামপন্থীরা বলছেন, অধিকার কেউ দিয়ে দেয় না—আদায় করে নিতে হয়। তাই তারা চান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি পর্যায়ে নিজেদের যৌক্তিক ও সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ভাড়াটিয়া নয়, বরং এই রাষ্ট্রের ন্যায্য অংশীদার হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে হবে।

‘নাগরিক কোয়ালিশন’-এ ইসলামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত না করাকে শুধু একবারের ঘটনা হিসেবে না দেখে একটি ধারাবাহিক বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন অনেকে। তাদের মতে, রাষ্ট্রযন্ত্র এখনও তথাকথিত এলিট শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে, যারা ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না।

এই বাস্তবতায় ইসলামপন্থীদের সামনে চ্যালেঞ্জ দুটো—একদিকে নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া, অপরদিকে মূলধারার রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করা। ‘নতুন বাংলাদেশ’ নামক যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার পূর্ণতা পাবে তখনই, যখন সব মত ও পথের মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহণ ও স্বীকৃতি পাবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post