আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্য ‘বাঁশের ডুলি’

বাংলার চিরায়ত গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল বাঁশের তৈরি ডুলি বা গোলা। একসময় ধান সংরক্ষণের জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি এই বিশেষ পাত্র ছিল কৃষক পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে এটি ছিল একটি অভিন্ন চিত্র। তবে সময়ের পরিবর্তনে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহ্যবাহী উপকরণটি।

ঐতিহ্যের প্রতীক ‘ডুলি’

গ্রামীণ প্রবীণ কৃষকদের ভাষ্যমতে, এক সময় একটি পরিবারের বাড়িতে যদি ডুলিভর্তি ধান না থাকত, তবে সেই পরিবারকে সমাজে দরিদ্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কেবল খাদ্য সংরক্ষণের উপকরণ নয়, ডুলি ছিল এক ধরনের আর্থিক সচ্ছলতার নির্দেশক। এমনকি বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও ডুলি ভর্তি ধান ছিল সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড। অনেকে চোর বা ডাকাতের ভয়ে ডুলির মধ্যে সোনা-রূপা কিংবা নগদ অর্থ লুকিয়ে রাখতেন।

ব্যবহারিক ও পরিবেশবান্ধব দিক

ডুলির অন্যতম বড় সুবিধা হলো এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি। এতে সংরক্ষিত ধান দীর্ঘ সময় ভালো থাকে এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও তুলনামূলক কম হয়। ধান কাটার পর শুকিয়ে কৃষকরা ডুলিতে সংরক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ধান বের করে চাল উৎপাদন করতেন বা বিক্রি করতেন।

বিলুপ্তির কারণ

বর্তমানে বাঁশের সংকট, উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং টেকসই প্লাস্টিক ও টিনজাত পাত্রের সহজলভ্যতার কারণে ডুলির ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই ডুলির নাম পর্যন্ত জানে না। গ্রামীণ কৃষকেরা এখন আধুনিক টিনের গোলা কিংবা পাকা গুদামে ধান সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকছেন। এগুলো তৈরি করতে সময় কম লাগে, স্থান সাশ্রয় হয় এবং বাইরে স্থাপন করাও সহজ।

কারিগর সংকট ও দক্ষতা হারানো

ডুলি তৈরি ছিল এক ধরনের লোকশিল্প। গ্রামাঞ্চলে বাঁশ ও ঝালর দিয়ে এই পাত্র তৈরি করতেন বিশেষজ্ঞ কারিগররা। কিন্তু এই পেশায় আগ্রহ হারানোর ফলে নতুন কারিগরের আগমন হচ্ছে না, ফলে ঐতিহ্যগত এই শিল্প হারিয়ে যাওয়ার মুখে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদ্বেগ

স্থানীয় কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাঁশের তৈরি গোলা বা ডুলি শুধুমাত্র একটি ব্যবহার্য সামগ্রী নয়, এটি গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি আবেগঘন উপাদান। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মধ্যে এ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

সম্ভাব্য সমাধান

এই ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। বাঁশচাষে প্রণোদনা প্রদান, কারিগরদের প্রশিক্ষণ, ও গ্রামীণ পণ্যের ব্র্যান্ডিং করে বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তুললে আবারও ডুলির ব্যবহার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।


---

এক সময়ের সোনালি ঐতিহ্য ‘বাঁশের ডুলি’ এখন কেবল স্মৃতির পাতায় স্থান করে নিচ্ছে। তবে সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ থাকলে এ হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে নতুন করে প্রাণ দেওয়া সম্ভব। ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখাই জাতি হিসেবে আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।#গ্রামীণঐতিহ্য #বাঁশেরডুলি #কৃষিভিত্তিকবাংলাদেশ #লোকশিল্প #টেকসইউন্নয়ন #গ্রামীণবাংলা #পরিবেশবান্ধব

Post a Comment

Previous Post Next Post