কিশোরগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে এখন আর সবুজের ছোঁয়া নেই। এসব জমির জায়গায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার ১১০টি ইটভাটার মধ্যে অন্তত ৩৭টি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফলে জনস্বাস্থ্য ও কৃষির ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি যেন এ বিষয়ে একেবারেই অনুপস্থিত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ফসলি জমি কেটে এসব ভাটার জন্য মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে জমির উর্বর টপসয়েল নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক এলাকাই এখন পরিণত হয়েছে গভীর খাদে বা পুকুরে। পাশাপাশি চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা শারীরিক জটিলতা।
অবৈধ ইটভাটাগুলোর বেশিরভাগেই জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পরিবেশ আইন পরিপন্থী। অনেক চিমনির উচ্চতা সরকার নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ না করায় ধোঁয়া সরাসরি আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে আশপাশের গ্রামে দিন দিন বাড়ছে শ্বাসযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
এছাড়াও শিশু শ্রমের ভয়াবহ ব্যবহার রয়েছে এইসব ভাটায়। বয়সে অনগ্রসর ছেলেমেয়েদের দিয়ে মাটি টানা, ইট সাজানো এবং বহন করানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ ‘শিশু শ্রম নিষিদ্ধ আইন’ স্পষ্টভাবে এসব কাজকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তার সাথে ‘লেনদেনের’ মাধ্যমে এই অবৈধ ইটভাটাগুলো বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে মালিকরা। অভিযোগ রয়েছে, যারা বেশি টাকা দেন, তারা প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় চলে যান বৈধ তালিকায়। একেকটি ভাটার আড়ালে চলছে এসিল্যান্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ এবং কখনো কখনো কিছু গণমাধ্যম প্রতিনিধির অর্থ লেনদেনের দুর্নীতিপূর্ণ চক্র।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, “জেলার কৃষি ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা বারবার আবেদন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে আমরা রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
অবৈধ তালিকাভুক্ত ইটভাটাগুলোর মধ্যে রয়েছে মেসার্স রাকিব ব্রিকস, জনতা ব্রিকস, হোসেনপুর ব্রিকস, মা ব্রিকস, লাকী ব্রিকস, ক্বাদরী ব্রিকস, হেলেনা ব্রিকসসহ মোট ৩৭টি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হাফেজ খালেকুজ্জামান বলেন, “আমাদের সমিতির আওতাধীন কোনো ইটভাটা অবৈধ নয়। যেসব ইটভাটা অবৈধ তালিকায় রয়েছে, তারা আমাদের সদস্য নয় এবং আমরা তাদের দায় নিতে পারি না।”
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মমিন ভূইয়া জানান, “অবৈধ ও পরিবেশবান্ধব নয় এমন ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রস্তুত। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে শিগগির অভিযান পরিচালনা করা হবে।”
শিশুশ্রমের অভিযোগ নিয়ে কথা হয় কিশোরগঞ্জ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ৯০টি ইটভাটাকে ছাড়পত্র দিয়েছি এবং শিশু শ্রম বিষয়ে মালিকদের একাধিকবার সতর্ক করেছি। আগের বছর দুটি মামলাও করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত বলেন, “পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তালিকার ভিত্তিতে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অচিরেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা সুবিধাভোগীদের আশীর্বাদে এসব ভাটা চলে আসছে। প্রশ্ন রয়ে যায়—প্রকৃত ব্যবস্থা কবে?
Post a Comment