কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার নামজাদা গোরখোদক মনু মিয়া—যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিনা পারিশ্রমিকে মৃত মানুষের কবর খুঁড়ে এসেছেন, বর্তমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন ঢাকার একটি হাসপাতালে। এ সময়ের মধ্যেই দুর্বৃত্তরা হত্যা করেছে তার সবচেয়ে আপন সঙ্গী ও প্রিয় ঘোড়া ‘বাহাদুর’-কে, যেটি তার জীবনের অন্যতম অবলম্বন ছিল।
মনু মিয়া শুধু ইটনা নয়, আশপাশের গ্রামগুলোতেও একজন পরিচিত নাম। যেখানেই মৃত্যুর খবর পেতেন, সেখানেই ছুটে যেতেন কবর খুঁড়তে। বিনিময়ে কোনোদিন কারও কাছ থেকে এক টাকাও নেননি তিনি। বয়স প্রায় ৬৭ বছর হলেও, এই দীর্ঘ সময়ে তিনি খুঁড়েছেন প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি কবর। এমন নিঃস্বার্থ সেবামূলক কাজের জন্য স্থানীয়দের কাছে তিনি একজন মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত।
জীবন সংগ্রামে একমাত্র সঙ্গী ছিল বাহাদুর
গোরখোদক হলেও তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল একটি ঘোড়া, যার নাম ছিল ‘বাহাদুর’। নিজস্ব জমি বিক্রি করে সেই বাহাদুরকে কিনেছিলেন মনু মিয়া। সেই ঘোড়াই ছিল তার কবর খোঁড়ার উপকরণ বহনের মাধ্যম এবং একান্ত সঙ্গী। বয়সের ভারে বারবার অসুস্থ হলেও, মৃতের খবর পেলেই বাহাদুরকে নিয়ে ছুটে যেতেন নির্দিষ্ট স্থানে।
মনু মিয়ার বাড়ি ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামে। সম্প্রতি হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ফলে পরিবারের সদস্যরা তাকে ঢাকার ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
অসুস্থতার সুযোগে নিহত হয় বাহাদুর
পরিবার ও এলাকাবাসীর মতে, মনু মিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ঘোড়াটিকে দেখভালের মতো কেউ বাড়িতে ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো ঘোড়াটি নিজের বাঁধন ছিঁড়ে বাইরে চলে যায়। পরে গত শুক্রবার, কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের কাঠখান ইউনিয়নের হাসিপুর গ্রামে ঘোড়াটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুর্বৃত্তরা ঘোড়াটিকে বল্লম দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনায় এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই বলছেন, এটি শুধু একটি প্রাণীর মৃত্যু নয়—এটি একটি নিঃস্বার্থ কর্মজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশের অপমৃত্যু।
পরিবারের দুশ্চিন্তা, মনু মিয়াকে জানানো হয়নি ঘোড়ার মৃত্যুর খবর
মনু মিয়ার স্ত্রী জানান, “আমরা সবাই ওনার চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখন বাহাদুরকে কেউ ঠিকভাবে খেয়াল করতে পারেনি। এখন শুনলাম, কেউ বাহাদুরকে মেরে ফেলেছে। আমরা এখনো ওনাকে এই দুঃসংবাদ দেইনি। উনি জানলে হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।”
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া ও দাবি
স্থানীয়রা মনু মিয়ার এই দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, “মনু মিয়ার মতো একজন নিঃস্বার্থ মানুষ যিনি আজীবন মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, তার এমন কষ্টের সময় আমরা চুপ থাকতে পারি না। আমরা চাই তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এবং বাহাদুর হত্যার সঠিক বিচার হোক।”
নিঃস্বার্থ মানবতার প্রতীক
মনু মিয়ার জীবনের গল্প শুধু একজন গোরখোদকের নয়, বরং একজন নিঃস্বার্থ মানুষ, যিনি জীবনের শেষপ্রান্তেও নিজের ভালো-মন্দের চিন্তা না করে অন্যের প্রয়োজনে ছুটে গেছেন। বাহাদুরের মৃত্যু নিঃসন্দেহে তার জীবনে বড় এক ক্ষতি। তবে তার এই মানবিক যাত্রা এখনো অনেকের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
Post a Comment