ইসলামী শিক্ষার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ তরুণ হাফেজ মো. সিয়াম হোসেনের স্বপ্ন ছিল নিজ গ্রামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে শিশুরা কোরআনের আলোয় আলোকিত হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে চলতেই ফ্যাসিস্ট সরকারের বুলেট কেড়ে নেয় তার জীবন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি, রেখে যান এক অনন্ত প্রেরণার দৃষ্টান্ত।
সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানার গোপরেখি দক্ষিণ গ্রামে জন্ম নেওয়া হাফেজ সিয়াম ছিলেন এনায়েতপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্র এবং পবিত্র কোরআনের হাফেজ। তার জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস জুড়েই ছিল ইসলাম, শিক্ষা এবং দেশপ্রেমের দৃপ্ত ছাপ। গ্রামে মাদরাসা না থাকায় একসময় তার মধ্যে তৈরি হয় এক অভাববোধ, যা থেকেই জন্ম নেয় নিজের হাতে একটি মাদরাসা গড়ার দৃঢ় সংকল্প।
নিজ উদ্যোগে শুরু করেন সহযোগিতা সংগ্রহ। কিন্তু ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সেই যাত্রা থেমে যায় চিরতরে। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বন্ধুদের সঙ্গে এনায়েতপুর থানার সামনে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। তার এই শহীদ হওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির ঘটনা নয়, বরং সময়ের ইতিহাসে এক অমূল্য আত্মত্যাগ।
শহীদ সিয়ামের মা লাকি খাতুন বলেন, “ওর স্বপ্ন ছিল গ্রামের শিশুদের জন্য একটি মাদরাসা গড়ে তোলা। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আমার ছেলে আজ শহীদ।” তার বাবা কুদ্দুস আলী জানান, “ছোটবেলা থেকেই সিয়াম মেধাবী ছিল। কোরআন হেফজ শেষ করার পর মাদরাসায় মাওলানা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার নিজের খরচ নিজেই চালাত মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করে।”
সিয়ামের মুত্যুর দিন তার মা জানতেন না যে, ছেলে আর কখনও ফিরবে না। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে গেলে পুলিশের গুলিতে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন সিয়াম। ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে যান তিনি। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেদিন রাতেই স্থানীয় আজুগড়া কবরস্থানে আরেক শহীদ শিহাবের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম বলেন, “সিয়াম অত্যন্ত ভদ্র এবং নরম স্বভাবের ছেলে ছিল। তার আজানের সুর এখনো কানে বাজে।” বাড়িতে তার নিজ হাতে লাগানো ফুলগাছ, ব্যায়ামের রিং এবং খোলা খেলার মাঠ যেন তার স্মৃতির নিরব সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে।
শহীদের নানি রবি খাতুন বলেন, “আমার নাতির মতো ছেলে আর হয় না। সে ছোটদের ভালোবাসত, বড়দের সম্মান করত। আন্দোলনে যাবে জানতাম, কিন্তু এভাবে ফিরে আসবে না—ভাবতেই পারিনি।”
সিয়ামের পরিবার এখন রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে। তার পিতা কুদ্দুস আলী সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, “আমার ছেলের নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হোক। তার স্বপ্ন যেন অপূর্ণ না থাকে।” একইসঙ্গে তিনি বড় ছেলের জন্য একটি সরকারি চাকরির আবেদন জানিয়েছেন, “আমরা দুইজনই অসুস্থ। বড় ছেলের ছোট চাকরির বেতনে সংসার চালানো সম্ভব নয়।”
সিয়ামের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যার ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। মা লাকি খাতুন বলেন, “আমার ছেলে কোরআনের হাফেজ ছিল। শহীদ হয়েছে দেশের জন্য। কে গুলি করেছে আমরা জানি না। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গুনাহ করতে চাই না। শুধু চাই, তার স্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ পায়।”
এখন পর্যন্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’, জামায়াতে ইসলামি, বিএনপি ও এনসিপি। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঈদের আগে উপহারসামগ্রী নিয়ে তাদের খোঁজ নিয়েছেন।
শহীদ সিয়ামের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এক প্রেরণার নাম হয়ে থাকবে। তার জীবনের গল্পটি বলে—স্বপ্ন যদি হয় সমাজের কল্যাণে, তবে সেই স্বপ্ন ধ্বংস হলেও রেখে যায় আলোর প্রদীপ। তার স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র যদি সিয়ামের নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে, সেটাই হবে তার স্বপ্নের প্রকৃত বাস্তবায়ন।
Post a Comment