পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার হোসেনাবাদ ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসায় চলছে এক অদ্ভুত চিত্র। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী মাত্র ৩ জন, অথচ শিক্ষক রয়েছেন ১৩ জন। সরকারের অর্থে পরিচালিত এই মাদরাসায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সৃষ্টি হয়েছে চরম বৈসাদৃশ্য, যা নিয়ে ক্ষোভ ও সমালোচনা বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে।
বোদা উপজেলার ঝলইশালশিরি ইউনিয়নের অন্তর্গত এই মাদরাসায় রোববার (১৮ মে) সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, উপস্থিত আছেন ১১ জন শিক্ষক এবং একজন কর্মচারী। এর মধ্যে আটজন শিক্ষক অফিসকক্ষে অবস্থান করছিলেন, দুজন গল্পে মগ্ন ছিলেন বারান্দায়। শুধু একটি শ্রেণিকক্ষে দেখা গেছে পাঠদান কার্যক্রম, যেখানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র তিনজন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত দিকেও রয়েছে অসঙ্গতি। যেখানে দশটি শ্রেণিকক্ষ থাকার কথা, সেখানে মাত্র ছয়টি শ্রেণিকক্ষ বিদ্যমান। শিক্ষকরা ক্লাস না করিয়ে বেশিরভাগ সময় অবসরেই কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০০২ সালে এমপিওভুক্ত হওয়া এই মাদরাসায় কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে ১৬৩ জন। অথচ ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী। বাস্তবতার সঙ্গে এই তথ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট গরমিল।
শিক্ষার্থীর সংকটে কার্যত অকার্যকর প্রতিষ্ঠান
কয়েক বছর আগেও এই মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে পর্যাপ্ত শিক্ষা পরিবেশ, মানসম্মত পাঠদান এবং তদারকির অভাবে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কেউ ভর্তি হলেও পরে অন্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি দিনে দিনে পরিণত হচ্ছে নামমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এমপিওভুক্ত হলেও এখানে শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। মাদরাসাটি দুপুরের মধ্যেই কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি বছর সরকারের লাখ লাখ টাকা বেতনের পেছনে খরচ হলেও শিক্ষার কোনও উন্নয়ন নেই। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনও অর্থ হয় না।”
শিক্ষকের বক্তব্য ও কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ
মাদরাসার সহকারী শিক্ষক জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ নিয়ে কিছু বলার নেই। আপনারা আসেন, নিউজ করেন, মানুষ পড়ে আমাদের ধিক্কার দেয়। কোনও তথ্য প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে কথা বলেন।”
এদিকে বোদা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আইবুল ইসলাম বলেন, “আমি নিজেই ওই মাদরাসায় গিয়ে সব শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের বলেছি, দ্রুত অভিভাবক সমাবেশ ও হোম ভিজিটের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাড়াতে হবে। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং আবারও ফলোআপ করব।”
প্রশ্নের মুখে সরকারের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা
এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—সরকারি অর্থে পরিচালিত এমন প্রতিষ্ঠান চালু রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু? শিক্ষার্থী নেই, পাঠদান কার্যত শূন্য, অথচ প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা বেতন বাবদ খরচ হচ্ছে। এতে করে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় হচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে এমন মাদরাসাগুলোর কার্যক্রমের ওপর কঠোর নজরদারি এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি হয়ে উঠেছে।
Post a Comment