মুক্তিযুদ্ধের পর পুরুষশূন্য গ্রামে নারীদের সাহসী এগিয়ে চলা: হাতপাখা তৈরিতে নতুন জীবনের গল্প

সংবাদ প্রতিবেদন: আদিবা আক্তার 
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন পুরো জাতি এক অবর্ণনীয় দুর্দিনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশের অনেক গ্রাম হারিয়েছিল তাদের পুরুষ সদস্যদের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলায় দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতো কিশোরগঞ্জের নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়া ও বর্মণপাড়া গ্রামও রক্ষা পায়নি। এই দুই গ্রামে জীবন দিয়েছেন অন্তত ৩৪ জন সাহসী পুরুষ। পরিবার হারানো, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া আর চোখের সামনে প্রিয়জনদের প্রাণনাশ — এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন গ্রামগুলোর নারীরা।

যুদ্ধে প্রাণ হারানো এসব পরিবারের নারীদের কাঁধেই তখন জীবনের হাল ধরার দায়িত্ব এসে পড়ে। যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। বেঁচে থাকার লড়াই, জীবিকার সংগ্রাম আর সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় তাদের। এই কঠিন সময়ে তারা আশ্রয় নেন ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ হস্তশিল্পের। তালপাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি ছিল তাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন।

নিকলীর সেই প্রান্তিক নারীরা একত্র হয়ে শুরু করেন হাতপাখা তৈরির কাজ। তালগাছ থেকে পাতা সংগ্রহ, সেগুলো শুকিয়ে প্রস্তুত করা, হাতে হাতে পাখা তৈরি করা— প্রতিটি ধাপে ছিল তাদের নিষ্ঠা ও শ্রম। এই হাতপাখাগুলো শুধু জীবিকার উৎসই নয়, বরং স্বাধীন দেশে আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।

একটি হাতপাখা তৈরি করতে সময় লাগত গড়ে ২ থেকে ৩ দিন। স্থানীয় হাটবাজার থেকে শুরু করে দূরের শহরেও এসব পাখা বিক্রি হতো। এতে নারীরা অর্থ উপার্জনের সুযোগ পান এবং পরিবার পরিচালনায় সরাসরি অবদান রাখতে শুরু করেন। সমাজে তাদের অবস্থানও পরিবর্তিত হতে থাকে ধীরে ধীরে।

এই উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই আনেনি, বরং আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। যারা আগে পরিবার চালানোর সিদ্ধান্তে অংশ নিতে পারতেন না, তারাই আজ উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃত।

নিকলীর স্থানীয় ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা জানান, এই এলাকার নারীরা যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও কখনো হাল ছাড়েননি। তাদের সংগ্রামী জীবনযাত্রা ও সাহসিকতা আজও পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগায়।

দামপাড়া ইউনিয়নের প্রবীণ এক নারী সাহস করে বলেন, “আমরা পুরুষ হারিয়েছি, ঘর হারিয়েছি, কিন্তু হাল ছাড়িনি। তালপাতার পাখার ভিতর দিয়ে আমাদের আশা বেঁচে ছিল।”

বর্তমানে হাতপাখার ব্যবহার কিছুটা কমে এলেও এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। অনেক তরুণ উদ্যোক্তাও এই হস্তশিল্পকে আধুনিক রূপ দিয়ে আবার বাজারজাত করার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ যেমন বীরত্বগাথা, তেমনি এই যুদ্ধ-পরবর্তী নারীদের এগিয়ে চলার গল্পটিও এক সাহসিকতার অধ্যায়। নিকলীর এই নারীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, সংগ্রাম শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই হয় না, কখনো কখনো নীরব হাতে তৈরি হাতপাখার ছায়াতেও লেখা হয় বিজয়ের কাব্য।

Post a Comment

Previous Post Next Post