কোর্টের আদেশে জুলাই বিপ্লবে নিহত শহীদ পলাশের লাশ উত্তোলনে মায়ের ও স্ত্রীর বাধা

টাঙ্গাইল: ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শহীদ ফিরোজ তালুকদার পলাশের মরদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু বুধবার (৭ মে) তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য উত্তোলন করতে গেলে মায়ের আহাজারি ও স্ত্রীর লিখিত আপত্তির কারণে বাধা সৃষ্টি হয়। ফলে প্রশাসন আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করেই ফিরে আসে।

পলাশের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর পৌর শহরের ঘাটান্দি গ্রামে। তিনি ঢাকার মিরপুরে সপরিবারে ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং রংপুর কেমিক্যাল কোম্পানিতে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তার একমাত্র কন্যাসন্তান রয়েছে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে পলাশ ছিলেন সবার বড়।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন পলাশ। তিনি সেদিন অসুস্থ মাকে দেখতে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে সেখানে সংঘর্ষে巻িয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলেই গুরুতর আহত হওয়ার পর মৃত্যু হয় তার।

পলাশের মৃত্যুর পর স্থানীয় ঘাটান্দি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এরপর থেকেই তার মৃত্যু ঘিরে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠতে থাকে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের লক্ষ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ঢাকা মেট্রো পুলিশের এসআই মেহেদী হাসান আদালতে আবেদন করলে ঢাকা মেট্রোপলিটন চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পলাশের মরদেহ উত্তোলনের অনুমতি দেন।

আদালতের সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ৭ মে সকালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে মরদেহ উত্তোলনের জন্য যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তারিকুল ইসলাম এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মেহেদী হাসান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পান পলাশের স্ত্রী রেশমা সুলতানা মরদেহ উত্তোলনের বিরুদ্ধে লিখিত আবেদন করেছেন। একই সঙ্গে পলাশের বৃদ্ধা মা বেনু বেগম কবর থেকে ছেলের মরদেহ উত্তোলনে বাধা দেন।

বৃদ্ধা মায়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। তিনি ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি আর কতোবার আমার ছেলের মরদেহ দেখবো? যাকে একবার কবর দিয়েছি, এখন আবার তুলে নেবো কেন? ও শান্তিতে ঘুমাক, কবর ভাঙবেন না।”
তার এই আবেগঘন আহ্বানে উপস্থিত স্থানীয়রাও ব্যথিত হন।

পলাশের স্ত্রী রেশমা সুলতানাও সাংবাদিকদের জানান, “আমার স্বামীকে নিয়ে যত তদন্তই হোক, মরদেহ উত্তোলন না করেই সেটা করা হোক। আমি চাই না আমার মেয়ের চোখের সামনে তার বাবার মরদেহ দ্বিতীয়বার দেখা হোক।”

এই পরিস্থিতিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তারিকুল ইসলাম জানান, “আমরা আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মরদেহ উত্তোলনের জন্য এসেছিলাম। কিন্তু মামলার বাদী এবং পরিবারের আপত্তির মুখে সেটি সম্ভব হয়নি। বিষয়টি আদালতকে জানানো হবে এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত আদালতই দেবেন।”

এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, যদি ময়নাতদন্তে শহীদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়, তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। আবার অনেকে বলছেন, একজন শহীদের মর্যাদা ও পারিবারিক আবেগকে সম্মান জানিয়ে মানবিকভাবে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।

এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পলাশের মতো সাধারণ একজন কর্মজীবী মানুষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শিকার হয়ে প্রাণ হারালে সেটির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে সেই তদন্ত যেন মর্যাদা ও মানবতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

শহীদ পলাশের মৃত্যু যেমন একটি আন্দোলনের গতি বদলে দিয়েছে, তেমনি মৃত্যুর পরের প্রতিটি অধ্যায় যেন নতুন করে বিচার ব্যবস্থার মানবিকতা, প্রশাসনিক বাস্তবতা এবং পারিবারিক অনুভূতির সংঘাতকে সামনে নিয়ে আসছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post