কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি:
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম যেন বাংলাদেশের লিচু চাষে এক জীবন্ত ইতিহাস। প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা লিচু আবাদ আজও টিকে আছে গর্বের সাথে। এবছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গ্রামটিতে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ আশা করছে, এই মৌসুমে বিক্রির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গ্রামটির তিন বর্গকিলোমিটার জুড়ে প্রতিটি বাড়ি, উঠান, পুকুরপাড় এমনকি খেতের আল পর্যন্ত লিচুগাছে ঘেরা। মিষ্টি ঘ্রাণ, ছোট বিচি, রসাল শাঁস আর নজরকাড়া গোলাপি রঙের কারণে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু সব সময়ই বাড়তি কদর পায়। তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা ছুটে আসেন এই গ্রামে।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, ১৮০২ সালের দিকে এক ব্যক্তি চীন থেকে দুটি লিচুর চারা এনে মঙ্গলবাড়িয়ায় রোপণ করেন। সেই দুটি চারাগাছ থেকেই ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় গ্রামজুড়ে লিচুর রাজত্ব। আজ সেই ঐতিহ্য বহন করছে শত শত গাছ, যার মধ্যে অনেক গাছই প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো।
বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়ায় দুই শতাধিক ছোট-বড় লিচু বাগান রয়েছে। এসব বাগান ও গাছের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। এই মৌসুমে তাঁরা দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছ পরিচর্যা, পানি দেওয়া, কীটনাশক প্রয়োগ এবং পাখি তাড়ানোর কাজে। অনেকেই গাছের নিচে মাচা তৈরি করে পাহারা দিচ্ছেন, যাতে পাখি বা চোরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
স্থানীয় কৃষক মিজানুর রহমান জানান, তাঁর ২৬টি লিচুগাছ থেকে তিনি আশা করছেন ৫০ হাজারের বেশি লিচু সংগ্রহ করতে পারবেন। তিনি বলেন, “আমার প্রত্যাশা, এবারের বাজারে ১০০ লিচু ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে পারব।”
ফকিরবাড়ির সাবেক কমিশনার শামিম মিয়ার বাড়িতেও রয়েছে প্রায় ৩০টি ২০০ বছরের পুরোনো গাছসহ আরও ৭০টির মতো লিচুগাছ। তিনি আশা করছেন, শুধু তাঁর গাছগুলো থেকেই অন্তত পাঁচ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করা সম্ভব হবে।
স্থানীয় আরেক চাষি মামুন নিয়া জানান, তাঁর নিজের কোনো গাছ না থাকলেও তিনি এই মৌসুমে ২০টি লিচুগাছ কিনেছেন। বাম্পার ফলনের কারণে ব্যবসার সম্ভাবনাও বেশি বলে তিনি মনে করেন।
মঙ্গলবাড়িয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মাদুল্লাহ জানান, মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর চাহিদা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ব্যাপক। সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও লন্ডনের প্রবাসীদের কাছে এখানকার লিচু পাঠানো হয়।
পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম বলেন, “এলাকার দোআঁশ ও বেলে মাটি লিচু চাষের জন্য আদর্শ। কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ, সময়মতো ওষুধ প্রয়োগ ও পরিচর্যার কারণে এবার ফলন আশাতীত ভালো হয়েছে। আমরা আশা করছি, এবার এখান থেকে ১০ কোটি টাকার মতো লিচু বিক্রি হবে।”
তবে এই সুনামকে ঘিরে কিছু সমস্যা থাকতেও দেখা যাচ্ছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, মঙ্গলবাড়িয়ার নাম ব্যবহার করে অন্য এলাকার লিচু বাজারজাত করা হচ্ছে, যা ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করছে। তাছাড়া, চাহিদা বেশি থাকায় মূল্যও তুলনামূলকভাবে বেশি রাখা হচ্ছে।
তবুও দুই শতকের ঐতিহ্য আর স্বাদে ভরপুর এই লিচুর জন্য মঙ্গলবাড়িয়া এখন এক জাতীয় ব্র্যান্ডে রূপ নিয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই লিচুর খ্যাতি পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও—যা সত্যিই বাংলাদেশের ফল চাষে এক গর্বের অধ্যায়।
Post a Comment