কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার এলংজুরী ইউনিয়নের কাটটেংগুর হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন মোহাম্মদ আনোহল (৪৫) নামে এক কৃষক। তিনি কাটটেংগুর গ্রামের মৃত মফিল উদ্দিনের ছেলে। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সন্ধ্যার দিকে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত আনোহল প্রতিদিনের মতোই হাওরে ধান কাটতে যান। হঠাৎ করে সন্ধ্যার দিকে আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় এবং বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় বজ্রপাতের সরাসরি আঘাতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরে স্থানীয়রা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যান।
এই মৃত্যুর খবর এলাকায় শোকের ছায়া ফেলেছে। একাধিক কৃষক জানান, তারা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাওরে ধান কাটতে যাচ্ছেন। কারণ ধান পাকার সময়সীমা শেষ হয়ে আসছে এবং দেরি করলে ফসলের ক্ষতি হবে। তবে হঠাৎ বজ্রপাতের কারণে তারা এখন আরও বেশি আতঙ্কে রয়েছেন।
একজন স্থানীয় কৃষক বলেন, “আকাশ কখন যে রূপ বদলায়, বুঝতেই পারি না। এক মুহূর্ত আগেও পরিষ্কার আকাশ থাকে, পর মুহূর্তেই কালো মেঘ, ঝড় আর বজ্রপাত। ধান তোলা ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামতে হয়।”
এর আগেও হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গত ২৮ এপ্রিল সকালের দিকে একই উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বজ্রপাতে ৩ জন কৃষক নিহত হন। এটি স্পষ্ট করছে যে, চলতি ধান মৌসুমে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বজ্রপাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হাওরবাসীদের সতর্ক করতে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে কালবৈশাখীর সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। এ সময় আকাশে বাতাসের ঘনত্ব ও গতি বেড়ে যায়, যার ফলে মেঘ দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে এবং হঠাৎ বজ্রঝড় সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, “হাওরাঞ্চলে খোলা আকাশের নিচে মানুষ কাজ করার সময় বজ্রপাতের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই যখনই আকাশে মেঘ জমে বা ঝড়ের আভাস পাওয়া যায়, তখন সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের দুর্যোগের সময় কৃষি কাজের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে আগাম সতর্কতা প্রচার বাড়াতে হবে।”
এদিকে ইটনা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কৃষকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, “আমরা কৃষকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি যেন আবহাওয়ার পূর্বাভাস না দেখে হাওরে না যান। প্রয়োজনে মাইকিং ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সতর্কতা কার্যক্রম চালানো হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ব্যক্তিগতভাবে কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। যেমন—আকাশে মেঘ দেখা দিলে মাঠ ফাঁকা করে দেওয়া, ধাতব যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকা এবং উঁচু গাছের নিচে না থাকা।
বজ্রপাতজনিত মৃত্যু প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো প্রতি বছরই হাওরের কৃষকরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফসল তুলতে বাধ্য হবেন এবং এই মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
Post a Comment