বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে থাকা এই খেলাটি আজকাল আর তেমন দেখা যায় না। কালের পরিক্রমায় ও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কাবাডির স্থান দখল করে নিয়েছে ডিজিটাল গেম ও টেলিভিশনের পর্দায় সম্প্রচারিত ক্রিকেট কিংবা ফুটবল। কিন্তু এবার কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হলো সেই হারিয়ে যাওয়া কাবাডি খেলা—যা নতুন প্রজন্মের কাছে ছিল প্রায় অপরিচিত এক অভিজ্ঞতা।
হারিয়ে যেতে বসা জাতীয় খেলা
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি, যা হাডুডু নামেও পরিচিত, এক সময় গ্রামে-গঞ্জে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক—সব বয়সী মানুষ কাবাডিতে মেতেছিলো। কিন্তু বর্তমানে স্কুল-কলেজে এই খেলাটির চর্চা নেই বললেই চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কাবাডির বদলে জায়গা করে নিয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা ভলিবল।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেকেই কাবাডির নাম জানে না, অনেকে নিয়মই জানে না। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী প্রথমবার এই খেলার নাম শুনেছে পাঠ্যবইয়ের শারীরিক শিক্ষা অধ্যায়ে। এটি আমাদের জাতীয় খেলাবলেও যে অনেকেই জানে না, সেটি আরও হতাশাজনক।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজন
এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বৈশাখী উৎসবের অংশ হিসেবে তারা আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী কাবাডি খেলার।
গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত এ খেলা দেখতে ভিড় জমায় হাজারো দর্শক। মাঠের চারপাশে ছিল উপচে পড়া ভিড়। যেন এক টুকরো গ্রাম উঠে এসেছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। লাল দল বনাম সবুজ দলের এই প্রতিযোগিতায় লাল দল জয়ী হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ শরিফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেলসহ বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
অতিথিদের বক্তব্যে উঠে এলো বাস্তবতা
অনুষ্ঠানে জেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ শরিফুল আলম বলেন, “এক সময় গ্রামবাংলার মানুষের প্রিয় খেলা ছিল কাবাডি। আজ সেই খেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এই খেলার নামই জানে না, খেলাটা কিভাবে হয় তাও জানে না। এই খেলাকে আবারও জনপ্রিয় করতে হলে সরকার ও সমাজের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “ফুটবল ও ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গঠন সহজ হলেও কাবাডিতে সেই সুযোগ কম, তাই তরুণরা আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কাবাডি আবারও জনপ্রিয়তা ফিরে পাবে।”
দর্শকদের অভিব্যক্তি
খেলা দেখতে আসা সানজিদ নামে এক তরুণী বলেন, “শুধু নাম শুনেছিলাম, কখনো সরাসরি কাবাডি খেলা দেখিনি। আজ মাঠে এসে সেই সুযোগ হলো। খুব ভালো লেগেছে।”
৮০ বছরের বৃদ্ধ জালাল উদ্দিন বলেন, “আমরা ছোটবেলায় অনেক কাবাডি খেলেছি। এখন আর খেলতে পারি না, তবে দেখতে এসেছি। সেই পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরে পেলাম।”
খেলায় অংশ নেয় দুই দল
ঐতিহ্যবাহী নিয়ম অনুযায়ী খেলোয়াড়দের “কাবাডি কাবাডি” শব্দ উচ্চারণ করে প্রতিপক্ষের কোর্টে প্রবেশ, প্রতিপক্ষকে স্পর্শ করে ফিরে আসা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দম ধরে রাখার দৃশ্য দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। খেলার শেষে অতিথিরা খেলোয়াড়দের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ডাক
এমন আয়োজনে কেবল খেলাধুলার বিকাশই নয়, বরং বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। শহরের ব্যস্ত জীবনে গ্রামীণ পরশ ফিরিয়ে আনা, এবং নতুন প্রজন্মকে গ্রামবাংলার শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এমন উদ্যোগ সময়োপযোগী।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যদি কাবাডি খেলার সম্প্রসারণ এবং প্রচারণা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে এই জাতীয় খেলা আরও পরিচিত হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কাবাডি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হলে কেবল জনপ্রিয়তাই বাড়বে না, বরং নতুন প্রতিভাও গড়ে উঠবে।
Post a Comment